দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা:  ভুয়া ও সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পাইয়ে দিয়েছেন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) সাবেক ইসি কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ও ওরফে বাবুল চিশতী। ব্যাংকের শেয়ার দেওয়ার কথা বলে নিয়েছেন কোটি টাকা। ব্যাংকের আমানতকারীর অর্থে লুট করে এভাবে হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত নয়টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরিবারের সদস্যসহ মোট মামলা ১২টি। এসব ঋণ কেলেঙ্কারির অর্থ ফেরত পেতে বাবুল চিশতীর স্থাবার-অস্থাবর ও ব্যাংক হিসাবে থাকা এফডিআরের অর্থ জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালাত।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাবুল চিশতীর ভাই মাজেদুল হক চিশতীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ওয়েল টেক্স। মাজেদুল হক এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখার নামে ওয়েল টেক্সের ঋণ রয়েছে। ওয়েল টেক্সের কর্মচারি আব্দুল ওয়াদুদ ওরফে কামরুলকে কৃত্রিমভাবে মালিক দেখানো হয় মেসার্স সাবাবা এ্যাপারেলসের। সাবাবা অ্যাপারেলসের নামে ব্যাক টু ব্যাক এলসি, ডিমান্ড লোন দেয়া হয় ১৫ কোটি ২৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। যদিও নাম সর্বস্ব এই প্রতিষ্ঠানের ঋণসীমা ছিল এক কোটি ৫০ লাখ টাকা।

কিন্তু পরবর্তীতে আরও ঋণ দেয়া হয় শাখা ব্যবস্থাপক জিয়া উদ্দিন আহমেদ, তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক একে এম শামীম ও বাবুল চিশতীর তত্বাব্ধানে। সর্বশেষ সাবাবা এ্যাপারেলসের নামে মোট ঋণ যায় ৩৯ কোটি ৯ লাখ টাকার। বর্তমানে এই ঋণের দায় ঠেকেছে ৪৫ কোটি পাঁচ লাখ টাকায়। এই ঋণের বিপরীতে মাত্র তিন কোটি ৫২ লাখ টাকার জমি বন্ধক রাখা হয়। যার বাজার মূল্য প্রদর্শিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

একইভাবে ওয়েল টেক্সের আরেক কর্মচারী মো. রাশেদ আলীকে মালিক দেখানো হয় এডিএম ডাইং অ্যান্ড ওয়াশিং নামে এক প্রতিষ্ঠানের। এই প্রতিষ্ঠানকেও ঋণ দেয়া হয় ৫৫ কোটি টাকার। এই দুই প্রতিষ্ঠানের নামেই ৮৮ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে যার দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১৪ কোটি টাকার বেশি।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এডিএম ডাইং অ্যান্ড ওয়াশিং এবং সাবাবা এ্যাপারেলসের ঠিকানা দেখানো হয় ওয়েল টেক্সের ঠিকানাকে। ওয়েল টেক্সের কারখানার ভিতরে এডিএম ও সাবাবার দুটো সাইনবোর্ড পায় দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা। ওয়েল টেক্সের কর্মচারিদের দেখানো হয় এডিএম ও সাবাবার কর্মচারি হিসেবে।

এভাবে বহু প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ সৃষ্টি করে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বাবুল চিশতী। ব্যাংকে রাখা আমানতকারীদের এই অর্থ দিয়ে গড়েছেন নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। ঢাকার মহাখালীর ডিওএইচএস অভিজাত এলাকায় কিনেছেন ফ্ল্যাট।

এছাড়া গ্রামের বাড়ি জামালপুরের বকশীগঞ্জের বিভিন্ন মৌজায় কিনেছেন অঢেল সম্পত্তি। এরমধ্যে ২৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকার সম্পত্তির তথ্য পেয়েছে দুদক। এই সম্পত্তির পরিমাণ বাবুল চিশতীর আয়কর বিবরণীতে নেই। বাবুল চিশতীর বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলোর একটিতে তার স্থাবার ও অস্থাবর সম্পত্তির এবং ব্যাংক হিসাব জব্দের আবেদন করেন দুদক কর্মকর্তা।

সেই আবেদনের ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত পাওয়া জামালপুরের সব সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। গত ২৭ জানুয়ারি এ আদেশ দেন মহানগর দায়রা জজ ও মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত। আদেশের কপি পাঠানো হয়েছে জামালপুর জেলা প্রশাসক, জেলা রেজিস্ট্রার, যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরকে। একই আদেশ পাঠানো হয় বাবুল চিশতীর নামে হিসাব থাকা সব ব্যাংকের কাছে।

উলেস্নখ্য, সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে প্রধান আসামি করে ৪ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির মামলায় মো. মাহবুবুল হক চিশতীকে জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার দেখিয়েছ আদালত।

বাবুল চিশতি ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) উদ্যোক্তা পরিচালক ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ৪ কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ছাড়া আরো ৯ জনকে আসামি করা হয়। গত ১০ ডিসেম্বর তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদ ১১ আসামিকে পলাতক দেখিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এরপর গত ৫ জানুয়ারি সব আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির আদেশ দিয়ে আগামী ২০ ফেব্রম্নয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করে আদালত। গত বছর ১০ জুলাই দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন।

মামলার অন্য আসামিরা হলেন ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শামীম, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের ব্যবসায়ী মো. শাহজাহান, একই এলাকার নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, সান্ত্রী রায় ওরফে সিমি ও তার স্বামী রণজিৎ চন্দ্র সাহা।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ফারমার্স ব্যাংকে শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহার নামে মঞ্জুরকৃত ঋণের ৪ কোটি টাকা সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সুপ্রিম কোর্ট সোনালী ব্যাংক শাখার হিসাবে জমা হয়। এরপর ওই টাকা বিভিন্নভাবে স্থানান্তর করে উত্তোলন করা হয়। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে নিজেরা লাভবান হয়ে এবং অন্যদের লাভবান করতে এ ধরনের অপরাধ করেন। তারা অবৈধভাবে ভুয়া ঋণ সৃষ্টির মাধ্যমে ৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।