দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: খেলাপি ঋণের প্রবণতা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চরম ঝুঁকি তৈরি করছে। এছাড়া খেলাপি ঋণের কারণে অনেক ব্যাংক এখন চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। এ হার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ওয়াশিংটন থেকে সম্প্রতি এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে ২০১৯ সালের প্রাক্কলিত হিসাব ব্যবহার করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণের হার নেপালে ১ দশমিক ৭ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, খেলাপি ঋণের অনুপাত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বা এর কাছাকাছি নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া দেশগুলোর মধ্যে এশিয়ার কয়েকটি দেশ রয়েছে। মালয়েশিয়ায় ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ গ্রাহকরা দেশ ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি পান না। থাইল্যান্ড সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি (এএমসি) গঠন করে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে সফলতা পেয়েছে। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে শ্রীলংকা রক্ষণশীল হয়ে উঠছে। ১৯৯৯ সালে দেশটিতে খেলাপি ঋণের হার ছিল মোট ঋণের ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ, যা ২০১৯ সাল শেষে ৩ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসে।

খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে চীন। দেশটিতে খেলাপিদের ওপর উড়োজাহাজ ও উচ্চগতির ট্রেনের টিকিট ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কর্পোরেট সংস্থার নির্বাহী কিংবা প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করতে পারেন না খেলাপিরা। এমনকি খেলাপিরা ব্যক্তিগত পরিচয়পত্র ব্যবহার করে কোনো হোটেল সুবিধা নিতে পারেন না, রিয়েল এস্টেট কিনতে পারেন না।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় খেলাপি ঋণের হারে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভুটান। দেশটিতে এ হার ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। ১০ দশমিক ৮ শতাংশ নিয়ে আফগানিস্তান তৃতীয়। চতুর্থ স্থানে আছে ভারত। দেশটির খেলাপি ঋণের হার ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ৯ দশমিক ৩ শতাংশ নিয়ে মালদ্বীপ পঞ্চম। পাকিস্তানে এ হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ। দেশটির অবস্থান ষষ্ঠ। শ্রীলংকা সপ্তম। দেশটিতে খেলাপি ঋণের হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের অনুপাত মোট বিতরণ করা ঋণের ২ শতাংশের মধ্যে রাখতে হয়, যা বাংলাদেশ কখনোই অর্জন করতে পারেনি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখেছে শুধু নেপাল। দেশটির খেলাপি ঋণ মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ। আইন ও নীতির কঠোর বাস্তবায়ন করে দ্রুত খেলাপি ঋণ কমিয়েছে শ্রীলংকাও।

বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বাড়লেও চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরসহ পরবর্তী অর্থবছরেও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপরেই থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তবে রাজস্ব কাঠামোর সংস্কারে তেমন অগ্রগতি না থাকায় শ্রীলংকার মতো বাংলাদেশেও রাজস্ব ঘাটতি আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এদিকে, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপিদের বিভিন্ন সেবা থেকে বয়কটের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরমধ্যে রয়েছে- ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের নামে কোনো ঋণ দেওয়া যাবে না, তাদের বিরদ্ধে ফৌজধারী মামলা দায়ের করতে পারবে ব্যাংক। এ ছাড়া স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপিদের বিজনেস ক্লাসে বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি-বাড়ি রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু, নতুন কোম্পানি নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা থাকবে।

এ সংক্রান্ত খসড়ায় ৫০টিরও বেশি ধারা-উপধারা সংযোজন, পরিমার্জন ও সংশোধন করা হয়েছে। আগামী ২১ দিন এই খসড়ার ওপর মতামত সংগ্রহ করে তা চূড়ান্ত করবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

গতমাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের খসড়ায় ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলা হয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে তাদের বিদেশ যাত্রার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। শুধু তারা বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ করতে পারবেন না বলে উল্লেখ আছে।

খসড়া আইনে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিত করতে দু’টি কমিটি কাজ করবে। আর ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের ছবিসহ নামের তালিকা ব্যাংকগুলো নিজেদের ওয়েবসাইটে ও সংবাদপত্রে প্রকাশ করবে।

খসড়া আইনে ব্যাংক আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজন মনে করলে কোনো ব্যাংকের ব্যবসা স্থগিত করা, মুনাফা বিতরণে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবে। তারপরও কোনো ব্যাংক দুর্বল হয়ে গেলে কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে ওই ব্যাংক অবসায়ন, একীভূতকরণ করতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চাইলে কোনো ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিলও করতে পারবে। ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর কোনো পরিচালক অপসারণ করে তার শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে বিক্রয় বা হস্তান্তর করতে পারবে।