এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা:  পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানি এবি ব্যাংক মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে বিস্ময়করভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এবি ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানো দেখে মনে হচ্ছে বিস্ময়কর ম্যাজিক। গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে আমানত সংগ্রহ, মন্দ ঋণ কমানো, প্রভিশন (সঞ্চিতি) ঘাটতি কমিয়ে আনা, মুনাফা বৃদ্ধিসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব ব্যাংকিং সূচকে এবি ব্যাংকের পরিবর্তনকে অনেকে ম্যাজিক হিসাবে দেখছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ম্ত্রা তিন মাসে ব্যাংকটির মন্দ ঋণ কমেছে ২ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। যা পুরো ব্যাংক সেক্টরের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। খেলাপি ঋণ ও আমানত-ঋণের আনুপাতিক হার বিবেচনায় ২০১৮ সালে প্রথম প্রজন্মের এই ব্যাংক খারাপ পরিস্থিতির মুখে পড়ে। গত বছরের শেষ দিকে এসে আমানতকারীদের আস্থা অর্জন ও খেলাপি ঋন কমানোর ক্ষেত্রে বেশ দক্ষতার পরিচয় দেয়। যেখানে অন্য অনেক বানিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ার পাশাপাশি আমানতের পরিমাণ কমেছে সেখানে এবি ব্যাংক ছিল ব্যতিক্রম।

গত বছর এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমানে। আগের বছর ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৩৭২ শতাংশ। মাত্র এক বছরে খেলাপি ঋণ কমেছে ৬২ শতাংশ। গত বছর ১৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পুন:তফশিলে বিশেষ সার্কুলার জারি করে। তাতে খেলাপিরা মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে মাত্র ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুন:তফশিলের সুযোগ পায়। তদুপরি ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মাধ্যমে কঠোর অবস্থান নেয় ব্যাংকটি। ব্যাংকিংয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উন্নতি, দক্ষ-অভিজ্ঞদের নিয়ে নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ রাতারাতি ব্যাংকটিকে আমানতকারী ও গ্রাহকদের পছন্দের তালিকায় নিয়ে আসে। এতে ব্যাংকের ডিপোজিট বৃদ্ধির পাশাপাশি নগদ প্রবাহও বেড়ে যায়।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ব্যাংকটি এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালে এই ব্যাংকের ডিপোজিট বেড়েছে ৩ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। যা যে কোন ব্যাংকের জন্য ঈর্ষণীয় উন্নতি। যদিও ২০১৮ সালে এর ডিপোজিট পরিস্থিতি সন্তোষজনক ছিল না। ওই বছর তারা ৫০ কোটি টাকা ডিপোজিট হারিয়েছিল, যা তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

সূত্র জানায, গত বছরের প্রথম ৯ মাসে প্রতি শেয়ারের বিপরীতে ব্যাংকটির ইতিবাচক নগদ প্রবাহ ৩২ টাকা ৬৭ পয়সা, যা আগের বছর ছিল ঋণাত্মক ১১ টাকা ৭৯ পয়সা। আমানত অনুপাতে ঋণের সীমা ২০১৮ সালে ব্যাংকটিকে দুশ্চিন্তায় ফেললেও ২০১৯ সালের শেষের দিকে এসে তা বেশ অনুকূলে চলে আসে।

বর্তমানে এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্ণর মোহাম্মদ এ (রুমি) আলী। তিনি বলেন, যখন তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখনও এই ব্যাংকের আমানত ও ঋণের অনুপাত (এডিআর) ছিল ১০০ শতাংশের কাছাকাছি। গত বছর তা কমিয়ে ৮৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংকগুলো তাদের আমানতের ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে।

আমানত ও ঋণের অনুপাত ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলে যে কোন ব্যাংক-কে ধার করে চলা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। এবি ব্যাংক দ্রুত এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে আবারও নিজেদেরকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে আসতে পেরেছে।

গত বছর চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব নেয়া রুমি আলী বলেন, ঋণ পুন:তফশিলে সরকারের বিশেষ নীতিমালা এবি ব্যাংকের মন্দঋণ কমাতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া খারাপ ঋণ আদায়ে ব্যাংক অনেক খেলাপির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। যে কারণে ব্যাংকের তারল্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গতবছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে ২ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। এতে গত বছর ডিসেম্বরে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমে দাড়িয়েছে ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, আগের বছর এই সময়ে যা ছিল প্রায় ৩৬ শতাংশ।

রুমি আলী বলেন, আমানতকারীরা গত বছর এবি ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা জমা করেছেন। তাতে প্রমাণিত হয় এই ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা আরো বেড়েছে। তারল্যের যে সংকট ছিল তাও এখন আর নেই। ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক সামর্থ সর্বক্ষেত্রে এবি ব্যাংক দারুন উন্নতি করেছে। এখন এটি ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ-যোগ করেন দেশের প্রথম সারির এই ব্যাংকার।

আধুনিক ব্যাংকিং চালু করতে ঋণ বিতরণ ব্যবস্থাপনায়ও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে এবি ব্যাংক। ইতিপূর্বে কিছু খারাপ ঋণের জন্য এই ব্যাংকের সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ হযেছিল। সেই সংকটের মধ্যে থেকে ব্যাংকটিকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ব্যাংকের সবশেষ ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান চৌধুরী আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করলে শীর্ষ প্রশাসনিক পদটি শূন্য অবস্থায় রেখে নয় মাস কার্যক্রম চলে।

সেই কঠিন পরিস্থিতিতে তখনকার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আফজাল ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। উচ্চ বেতনের প্রস্তাবেও তখন কোন ব্যাংকার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নিচ্ছিলেন না। যদিও ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ তিন মাসের বেশি শূন্য রেখে কোন ব্যাংক চলতে পারে না। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে তারিক আফজালকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে পদোন্নতি দেয় এবি ব্যাংক।
ব্যাংকের অবস্থা যখন ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছিল তখনই চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্ণর মোহাম্মদ এ (রুমি) আলী)। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোর্শেদ খানের প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক ট্রেডার্সের পছন্দে তিনি বোর্ডে আসীন হন। রুমি আলী বলেন, ‘‘ ব্যাংকটিকে ঘুরে দাড় করানোই ছিল আমার টার্গেট। এবি ব্যাংক কোনও বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। ব্যাংকিং খাত যদি সঠিকভাবে কাজ করে, বোর্ড এবং পরিচালনায় যদি ভাল সদস্য থাকে, আমরা আশা করি ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াবে। ”

বর্তমান পরিচালনা কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ব্যাংটিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। মন্দ ঋণ কমিয়ে গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটি প্রভিশন ঘাটতিও কমিয়ে এনেছে। সেপ্টেম্বরে প্রভিশন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা, ডিসেম্বরে তা কমে দাড়িয়েছে ৬৩৭ কোটি টাকা। ভবিষ্যতের ঝুঁকি এড়াতে খারাপ ঋণের বিপরীতে লাভের একটি অংশ ব্যাংকগুলোকে ‘প্রভিশন‘ হিসাবে রেখে দিতে হয়। এর ফলে ব্যাংকের লাভের পরিমাণ কমে যায়। মন্দ ঋণ কমে আসায় এবি ব্যাংকের প্রভিশনও কমে এসেছে। এতে ব্যাংকের লাভের পরিমাণও বাড়ছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের হিসাবে, গত বছরের নয় মাসে ব্যাংকটি ১৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। একসময় যে ব্যাংকটি এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার অধিক মুনাফা নিয়ে ব্যাংকিং খাতের মধ্যে সর্বাধিক মুনাফা অর্জনকারীদের মধ্যে স্থান পেয়েছিল, ২০১৮ সালে তারা মাত্র ১.৮ কোটি টাকা মুনাফা করে। তদুপরি, এই লাভটিও তখন অতিরঞ্জিত বলে মনে হচ্ছিল। কেননা তখন প্রভিশন ঘাটতি ছিল প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। লভ্যাংশ ঘোষণা না করায় ২০১৭ সাল থেকে ব্যাংক শেয়ার বাজারে “জেড” ক্যাটাগরিতে রয়েছে। অর্থিক অবস্থার উন্নতি হলেও ব্যাংটির শেয়ারের ফেস ভেলু এখনও ১০ টাকার নীচে রয়েছে।