দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নানামুখী প্রচেষ্টার পরও শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা থামানো যাচ্ছে না। আগের বছরের ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের প্রথম দুই মাসেও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি করেছেন বেশি। বিদেশিদের এমন অব্যাহত বিক্রির চাপ সার্বিক শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য তফসিলি ব্যাংকগুলোকে ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের সুযোগ দিলে সার্বিক বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

এ পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি শুরু করেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ৪৪ শতাংশের বেশি রয়েছে বিদেশিদের কাছে। ফলে তাদের কাছ থেকে এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রির বড় চাপ আসায় সার্বিক বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত শেয়ারবাজারে টানা দরপতন হয়। দরপতনের কবলে পড়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক কমে ৩৪৮ পয়েন্ট।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিক্রির চাপ বাড়ান। এরপর একে একে ১২ মাস কেটে গেলেও বিদেশিদের বিক্রির চাপ বন্ধ হয়নি। এর মধ্যে শেষ ১২ মাসের প্রতি মাসে বিদেশিরা যে পরিমাণ টাকার শেয়ার কিনেছেন বিক্রি করেছেন তার থেকে বেশি টাকার।

বিদেশিদের এ বিক্রির চাপে সার্বিক শেয়ারবাজার একপ্রকার পিষ্ট হয়েছে। বিদেশিদের বিক্রির চাপ নিতে না পেরে অব্যাহত দরপতনের কবলে পড়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক কমে দেড় হাজার পয়েন্টের ওপর। অন্যদিকে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মিলিতভাবে কমে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার। অর্থাৎ শেয়ারবাজারের পতনে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বিদেশিদের বিক্রির চাপে শেয়ারবাজার নাজেহাল হয়ে পড়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও নিয়ে কাজ করে এমন ব্রোকারেজ হাউজের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা- বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে বিএসইসির তৎপরতা কোনো কাজে আসেনি। উল্টো বিদেশিদের বিক্রির চাপ রেকর্ডের পর রেকর্ড ভেঙেছে।

দেশের শেয়ারবাজারে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে টানা ১২ মাস বিদেশিরা কেনার থেকে বিক্রি বেশি করেছেন। শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এর আগে কখনও বিদেশিরা টানা এত মাস শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেননি। এর আগে ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত টানা পাঁচ মাস বিদেশিরা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন। মাসের হিসাবে এটাই বিদেশিদের টানা বিক্রির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড। এদিকে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ লুকিয়ে রাখার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশনা ও জনসংযোগ বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) শফিকুর রহমান প্রতি মাসে সাংবাদিকদের বিদেশিদের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য দেন। তবে ফেব্রুয়ারি মাসের ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য দেননি ডিএসইর এ কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের থেকে যোগাযোগ করা হলে শফিকুর রহমান বলেন, এবার বিদেশিদের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য দেয়া যাবে না। এ বিষয়ে উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা আছে।

ডিএসইর একটি সূত্রে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে বিদেশিরা ৫৫৮ কোটি টাকার ওপরে লেনদেন করেছেন। এ মাসেও বিদেশিদের ক্রয় থেকে বিক্রির পরিমাণ বেশি। মাসের শেষ দিকে এসে ব্র্যাক ব্যাংকের বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা থাকায় শেয়ারবাজারে টানা দরপতন ঘটে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের সুযোগ দেওয়ার পর বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার মুখে রহস্যজনকভাবে বিদেশিদের এ শেয়ার বিক্রির চাপ আসে।

এ বিষয় যোগাযোগ করা হলে ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করলে অবশ্যই সার্বিক শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে কেউ শেয়ার বিক্রি করলে তাকে তো মানা করা যাবে না। মার্কেটে সবাই ট্রেডার। কেউ শেয়ার ধরে রাখতে চাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ব্যাংকের বিশেষ তহবিলের ঘোষণা আসার পর ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারের দাম বেড়ে ৪৬ টাকায় ওঠে (প্রকৃত দাম ওঠে ৫১ টাকা)। এরপর বিদেশিরা ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করা শুরু করেন। যখন কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৩৬ টাকা ছিল তখন তারা বিক্রি করেননি। এর মানে তারা একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। সেই সুযোগ তারা কাজে লাগিয়েছেন।

ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির চাপের কারণেই গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত শেয়ারবাজারে টানা দরপতন হয় বলে অভিমত এ বিশ্লেষকের। তার মতে, ব্র্যাক ব্যাংকের বিক্রির চাপ আসার পর শেয়ারবাজারে পতন শুরু হয়। এরপর ১-২ টাকা করে সব ব্যাংকের শেয়ারের দরপতন হয়। আবার গ্রামীণফোনের শেয়ারের দাম কিছুটা বাড়লে কোম্পানিটির শেয়ারেও বিক্রির চাপ আসে।

ডিএসইর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জনা গেছে, ২০১৯ সালের প্রথম দুই মাস- জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে টাকার অঙ্কে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রির পরিমাণ কম ছিল। তবে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ১০ মাস ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি হয়। এতে ২০১৯ সালজুড়ে বিদেশিদের ৩৬৭৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ক্রয়ের বিপরীতে বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪১৬৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিদেশিরা ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন ৪৮৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা। ২০১৯ সালজুড়ে থাকা বিদেশিদের এ শেয়ার বিক্রির চাপ চলতি বছরের প্রথম মাসেও অব্যাহত থাকে। জানুয়ারি মাসজুড়ে বিদেশিদের ক্রয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে বিক্রি করেন ৪০২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদেশিদের ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি হয় ১২৮ কোটি টাকা।

এ বিষয় যোগাযোগ করা হলে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যে কয়টি প্রতিষ্ঠানে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে তার মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক অন্যতম। বিদেশিরা ব্যাংকটির শেয়ার বিক্রি করায় অন্য প্রতিষ্ঠানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ব্র্যাক ব্যাংকের ঋণের বেশিরভাগই এসএমই। ছয়-নয় সুদ হারের কারণে ব্যাংকটির মুনাফার পরিমাণ কমে যেতে পারে— এমন আশঙ্কায় হয়তো বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, বিদেশিরা যখন শেয়ার কেনেন তখন সার্বিক বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। আবার তারা শেয়ার বিক্রি করলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিদেশিরা কী কারণে টানা শেয়ার বিক্রি করছেন তা বলা মুশকিল। এমনও হতে পারে তারা বিকল্প ভালো বিনিয়োগের সুযোগ পাওয়ায় শেয়ার বিক্রি করছেন।

ডিএসইর অপর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করছেন এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেকোনো কারণেই হোক তারা আস্থা পাচ্ছেন না। তবে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির কারণে দু-একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু সার্বিক বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়া যৌক্তিক নয়। ‘সরকার শেয়ারবাজার ভালো করতে খুবই আন্তরিক। বাজারের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। আমরা আশা করি, শিগগিরই বাজার ভালো অবস্থানে যাবে’— যোগ করেন তিনি।