মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ব্যথর্তার ভারে নুয়ে পড়ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ‘ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ’ (আইসিবি)। এই প্রতিষ্ঠানটি এখন সর্বঅঙ্গে ব্যাথা ওষুধ দেবো কোথা এর মত অবস্থা। এটিকে নিয়ে ইতিমধ্যে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণে বিশ্লেষণ মুলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ লুকিয়ে থাকায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। পুঁজিবাজারের দুঃসময়ে সহযোগিতা করা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও নিজস্ব পোর্টফোলিওকে পঁচা শেয়ারের ভাগাড়ে পরিণত করা প্রতিষ্ঠানটি নিজেই দূরবস্থায়। এই পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারে সাপোর্ট দেওয়াতো দূরের কথা, আইসিবির নিজস্ব দুরবস্থারোধে দরকার আরেকটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান।

শেয়ারবাজারে বর্তমানে ৩৫৭টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। যেখানে কোন ধরনের বিচার-বিশ্লেষন ছাড়াই প্রায় সব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে অর্থ সংকটে পড়েছে আইসিবি। এই তালিকায় ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেটের (ওটিসি) কোম্পানি, ‘জেড’ ক্যাটাগরি ও উৎপাদন বন্ধ থাকা এমন অসংখ্য কোম্পানি রয়েছে। এছাড়া এমন কোম্পানিতেও বিনিয়োগ রয়েছে, যার নাম অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।

এক দিকে প্রতিষ্ঠানটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে চলতি অর্থবছরের প্রথম অর্ধ বার্ষিকে করা ‘বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি’র (এপিএ) বেশির ভাগ সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে , অন্য দিকে খেলাপি ঋণ আদায় করতেও চরম ব্যর্থ হচ্ছে আইসিবি। অভিযোগ রয়েছে, অনেক খারাপ কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করে কয়েক বছর ধরে ‘ধরা’ অবস্থায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।  চুক্তি অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে আইসিবিকে খেলাপি ঋণ ও অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল যথাক্রমে ১২৫ কোটি টাকা এবং ২০ কোটি টাকা। এই লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে ১২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা (১০ শতাংশ) এবং অবলোপনকৃত ঋণ থেকে এক ‘কানা কড়িও’ আদায় করতে পারেনি আইসিবি।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘আইসিবি’র পোর্টফলিও যদি দেখেন তা হলে অবাক হয়ে যাবেন, সেখানে এমন সব কোম্পানির নাম রয়েছে যেগুলো অনেকটা দেউলিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু আইসিবি এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে বসে আছে। দ্যাটস দ্য আইসিবি! আর এই আইসিবির পেছনে সরকার প্রচুর অর্থ ঢেলে যাচ্ছে। ’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে নিজস্ব পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগ, স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের পরিমাণ ও নতুন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়ানো, ইক্যুইটি হিসেবে অর্থ বিতরণ ও আদায়, মার্জিন ঋণ বিতরণ ও আদায়, খেলাপি ঋণ ও অবলোপনকৃত আদায়, ইস্যু ম্যানেজমেন্ট, আন্ডার রাইটিং ইত্যাদি সূচকে আইসিবি’র অর্জনও সন্তোষজনক নয়।

তবে মিউচ্যুয়াল ফান্ড সার্টিফিকেট বিক্রি, বিতরণকৃত প্রকল্প ঋণ আদায় ও মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সংস্থাটির অর্জন অর্ধ বার্ষিকের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অধিক।
তবে আইসিবি’র পক্ষ থেকে তাদের এই খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য ছয়টি কারণকে দায়ী করা হয়েছে। কারণগুলো হলো: পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে মুদ্রাবাজার থেকে পরিবর্তনশীল সুদহারে সংগৃহীত তহবিলের ওপর নির্ভরশীলতা ও পর্যাপ্ত তহবিল প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতা; স্বল্পমেয়াদে তহবিল সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের ফলে সংস্থার তহবিল ব্যয় ও সুদ ব্যয় বেড়ে যাওয়া; বিপুল মার্জিন ঋণ অনাদায়ী থাকা; শ্রেণিকৃত ঋণ আদায়ে দীর্ঘসূত্রিতা, আইসিবি’র ন্যায় সমজাতীয় একক কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় বিনিয়োগ প্রত্যাহারে সমস্যা, রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে পোর্টফোলিও’র ব্যবস্থাপনা আয়ের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীলতা সংস্থাটির প্রধান সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে পুঁজিবাজারে আইসিবি’র বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে দুই হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৯) সংস্থাটি বিনিয়োগ করেছে এক হাজার ৭২ কোটি টাকা। এটি বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির জন্য দেশের দুই স্টক এক্সজেঞ্জে লেনদেনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে গত ডিসেম্বর শেষে লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৭১৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এটি লক্ষ্যমাত্রার ২৮ শতাংশ।

অন্যদিকে নতুন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়ানো, ইস্যু ম্যানেজমেন্ট ও আন্ডার-রাইটিংয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল যথাক্রমে এক হাজার ৯০০ জন, ১০টি ও নয়টি। এর বিপরীতে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৪১৭ জন (অর্জনের হার ২২ শতাংশ) এবং ইস্যু ম্যানেজমেন্ট ও আন্ডার-রাইটিংয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে দু’টি (২০ শতাংশ) ও চারটি (৪৪ শতাংশ)।

অন্য দিকে মিউচ্যুয়াল ফান্ড সার্টিফিকেট বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে বিক্রয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এটি লক্ষ্যমাত্রার ৯৪ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে আইসিবি’র মার্জিন ঋণ বিতরণ ও ইক্যুইটি হিসেবে অর্থ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে যথাক্রমে ৮০০ কোটি টাকা এবং ৪০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ঋণ দেয়া হয়েছে যথাক্রমে ২৮৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা (৩৬ শতাংশ) এবং ১৬ কোটি তি লাখ টাকা (৪০ শতাংশ)। এ ছাড়া ৩৭৫ কোটি টাকা প্রকল্প ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিতরণ করা হয়েছে ৫৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা (১৪ শতাংশ)।

বিভিন্ন খাতে ঋণ আদায়ের মধ্যে বকেয়া মার্জিন ঋণ খাতে ৮৫০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৩২৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা (৩৮ শতাংশ); ১৩০ কোটি টাকা প্রকল্প ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৯৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা (৭৭ শতাংশ) এবং ইক্যুইটি হিসেবে বিতরণকৃত অর্থ থেকে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা (৩৩ শতাংশ) আদায় করেছে আইসিবি।

আইসিবি এই পারফরম্যান্সের বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেছেন, আইসিবিতে ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ রয়েছে তা আমি অস্বীকার কারব না; কিন্তু অনেকসময় সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে খারাপ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতে আমাদের বাধ্য করা হয়। আমরা জানি এই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে কখনো অর্থ তুলে আনা সম্ভব নয়। যেমন সাবেক ফারমার্স ব্যাংক, যা বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক হয়েছে। সেটিকে বাঁচানোর জন্যও আমাদের মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এই অর্থ কি ফেরত পাওয়া সম্ভব? তিনি বলেন, আবার আইসিবির কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তার কারণে কিছু খারাপ কোম্পানিতে আমাদের বিনিয়োগ করতে হয়েছে, যেগুলোর কাছ থেকে টাকার ফেরত পাওয়া যাবে না।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিষ্টেম বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, আইসিবির বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে কোন কার্যকরি নীতিমালা আছে বলে মনে হয় না। এরা অন্ধভাবে বিনিয়োগ করেছে। অথবা এরা কারসাজিমূলক বিনিয়োগ করেছে। এক্ষেত্রে হয়তো আইসিবির ম্যানেজম্যান্টের ব্যক্তিগত লাভজনক সর্ম্পক আছে। অন্যথায় এ ধরনের দুর্বল, সুশাসনবিহীন ও আর্থিকভাবে দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ বোধগম্য নয়। এছাড়া তারা কেনো সব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে, এটাও আমার কাছে বোধগম্য নয়। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইসিবির বিশ্লেষণ থাকা উচিত ছিল।

তিনি আরো বলেন, পুঁজিবাজারে আইসিবির ভূমিকা অনেক আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। শেয়ারবাজারে দুঃসময়ে ক্রয় বাড়ানো দরকার হলেও আইসিবির পক্ষে তা সম্ভব হয় না। যতবারই প্রতিষ্ঠানটিকে বিভিন্নভাবে অর্থ সহযোগিতা দেওয়া হোক না কেনো, কোনবারই তার প্রতিফলন শেয়ারবাজারে দেখা যায় না। যে প্রতিষ্ঠানটি অন্যদের স্বার্থ উদ্ধারে পঁচা শেয়ারের পার্কিংয়ের দায়িত্ব পালন করে বলে অভিযোগ আছে। তাইতো এখন আইসিবিকে অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই দ্বিমত প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে শেয়ারবাজারের স্বার্থে বর্তমান ভঙ্গুর আইসিবিকে শক্তিশালী করা অথবা বিকল্প বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান গড়ার দাবি সব মহলের।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আইসিবির বিরুদ্ধে দুর্বল ও বন্ধ কোম্পানির শেয়ার কেনার অভিযোগ শুনে আসছি। এছাড়া গেম্বলারদের স্বার্থে উচ্চ দরে নতুন শেয়ার কিনে পার্কিং করার অভিযোগও আছে। এ অভিযোগ থেকে বিগত কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করা আইসিবির কোন ব্যবস্থাপনা পরিচালকই (এমডি) বের হতে পারেননি। এই বিষয়টি স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে পরিস্কার করার জন্য তদন্ত করা উচিত।

ডিএসইর আরেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা নিয়ে আইসিবি অনেক আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। ব্যক্তিগত স্বার্থে লাভের জন্য এমনটি করা হয় বলে অভিযোগ আছে। কোম্পানিটির ২০১৯ সালের ৩০ জুনের পোর্টফোলিও’র মাধ্যমে সেই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। এই প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা থেকে আইসিবির কোন এমডি বেরিয়ে আসতে পারেনি। জবাবদিহিতার অভাবে এমনটি হচ্ছে।