দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ২০১০ সালে দেশের পুঁজিবাজারে মহাধসের পর বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৎকালীন বিএসইসিকে পুনর্গঠন করা হয়। তখন বর্তমান চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেনসহ অন্যান্য কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

কিন্তু নয় বছর অতিবাহিত হলেও বাজারের প্রতি আস্থা ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে বর্তমান কমিশন। উল্টো বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে বিনিয়োগকারীসহ বাজারসংশ্লিষ্টদের বিরাগভাজন হয়েছে এই কমিশন। বিশেষ করে দুর্বল মানের অনেক কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেনের বিরুদ্ধে।

এর মধ্যে চলমান মন্দায় পুঁজিবাজার যেন গুজবের উর্বরক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। নানারকম গুজবে ক্রমেই ভারি হয়ে উঠছে পুঁজিবাজারের বাতাস। এর মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন হয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এর চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসনের মেয়াদ বৃদ্ধির গুজব।

বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে ড. এম খায়রুল হোসেনের তৃতীয় দফায় নিয়োগের মেয়াদ আগামী ১০ মে শেষ হচ্ছে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে পুঁজিবাজারে গুজব ড. খায়রুল হোসেন তার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছেন। এর প্রেক্ষিতে বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাত করলে তিনি মেয়াদ বাড়ানোর কোনো আবেদন করার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

ড. খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন পুঁজিবাজারের অনেকগুলো সংস্কার করলে সেকেন্ডারি বাজারে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। পুঁজিবাজারের অভ্যন্তরীন এবং বাইরের নানা বিষয়ের প্রভাবে বাজার গত কয়েক বছর ধরেই বাজার গতিহীন। মূল্যসূচক ক্রমাগত কমছে।

দর পতনের জন্য বিএসইসিকে নানাভাবে দায়ী করা হয়, বিশেষ করে বর্তমান কমিশনের মেয়াদে দুর্বল মৌলের অসংখ্য কোম্পানির আইপিওঅনুমোদনের বিষয়টি বাজারের বর্তমান পরিস্থিতির অন্যতম কারণ বলে সাধারণভাবে অভিযোগ করা হয়। এমন অবস্থায় অনেক বিনিয়োগকারী ভাবছেন, কমিশনে নতুন মুখ এলে হয়তো হারানো আস্থা ফিরে আসবে, বাজার ফের তার গতি ফিরে পাবে।

অন্যদিকে বর্তমান কমিশনের কিছু উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন পক্ষও নানা গুজব ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এমন ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে, বর্তমান কমিশনে পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত বাজারে আস্থা ফিরবে না, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। বাইরের নানা ঘটনায় যখনই পুঁজিবাজারে একটু তীব্র দর পতন হয়, তখনই বিএসইসির চেয়ারম্যান সংক্রান্ত নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-রবিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে ড. এম খায়রুল হোসেন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে গত ৮ বছরে যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে, তার অর্ধেকেরও বেশি নিম্নমানের বলে অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করে এলেও, দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে স্বপদে বহাল আছেন তিনি।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারী মো. মহসিন বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতার কারণেই বর্তমানে বাজারের এই বেহালদশা। বাজারের উন্নয়ন নয়, তারা নিজেদের উন্নয়ন নিয়েই সবসময় ব্যস্ত। অবিলম্বে বিএসইসি চেয়ারম্যানের উচিৎ বাজারের স্বার্থে পদত্যাগ করে চলে যাওয়া। কেননা, তার ওপর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো রকম আস্থা ও বিশ্বাস নেই।

উল্লেখ, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে কেলেঙ্কারির পর ২০১১ সালে বিএসইসি পুনর্গঠন করা হয়। ওই বছরের ১৫ মে সংস্থাটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান খায়রুল হোসেন। বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে তিনি রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান ছিলেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের মে মাসে তিনি বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে তৃতীয় মেয়াদে নিয়োগ পান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের এক নেতা বলেন, বিএসইসি চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন শুরু থেকেই বিতর্কিত। অনেক আগেই তাকে এই পদ থেকে সরিয়ে দেয়া উচিৎ ছিলো। তার কারণেই অসংখ্য দুর্বল কোম্পানি আমাদের শেয়ারবাজারে যুক্ত হয়েছে। তারা বাজার থেকে টাকা লুটে নিয়ে চলে গেছে। কিন্তু বিএসইসি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। এর দায়ভার খায়রুল হোসেন কিছুতেই এড়াতে পারেন না। বর্তমান কমিশনের আমলে অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ১০টি রয়েছে জেড ক্যাটাগরিতে। এই কমিশনের উপর সাধারন বিনিয়োগকারীর আস্থা নেই।

তার মেয়াদে আনা কোম্পানিগুলো হচ্ছে- সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল, ঢাকা ডায়িং, এমারেল্ড অয়েল, ইভিন্স টেক্সটাইল, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিবিবি পাওয়ার, আইএসএন লিমিটেড, খুলনা পেপার, পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও তুংহাই ডায়িং।

এছাড়া তার আমলে অনুমোদন পাওয়া আরও যেসব কোম্পানির ইপিএস কমেছে বা বরাদ্দ মূল্যের নিচে লেনদেন হচ্ছে, সেগুলো হলো: জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, জাহিন স্পিনিং মিলস, রংপুর ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রডাক্টস, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন, এনভয় টেক্সটাইলস, ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস, আমরা টেকনোলজিস, সায়হাম কটন মিলস, অ্যাপোলো ইস্পাত, ফ্যামিলিটেক্স, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস, বেঙ্গল উইন্ডসর থার্মোপ্লাস্টিক, ওরিয়ন ফার্মা, গ্লোবাল হেভি কেমিক্যাল কোম্পানি, হামিদ ফ্যাব্রিক্স লিমিটেড, ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডায়িং ইন্ডাস্ট্রিজ, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ লিমিটেড, ফার কেমিক্যাল, দি পেনিনসুলা চিটাগং লিমিটেড, মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিলস, রিজেন্ট টেক্সটাইলস, তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ, ন্যাশনাল ফিড মিল, ইয়াকিন পলিমার উল্লেখযোগ্য।

এ বিষয় যোগাযোগ করা হলে ড. এম খায়রুল হোসেন বলেন,বিএসইসিতে থাকার আর ইচ্ছা নেই তার। এছাড়া তিনি মেয়াদ বাড়ানোর কোনো আবেদন করেননি। আবেদনের কথা ভাবছেনও না। বর্তমান মেয়াদ শেষে তিনি কমিশন থেকে বিদায় নিতে চান। নতুন মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার কোনো ইচ্ছাই তার নেই।