দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর সোমবার পুঁজিবাজারে বড় ধরনের ধস হয়েছে। করোনা ভাইরাসের পাশাপাশি বিএসইসি চেয়ারম্যান ফের বহাল থাকছে এমন গুজবে পুঁজিবাজারে স্মরনকালের ‘মহাধস’ হয়েছে। এতে সাধারন বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক এ যাবৎকালের সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে গেছে। তেমনি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পদক্ষেপের পরও পুঁজিবাজারে পতন ঠেকানো পারছেন না। পুঁজিবাজারের কারনে বর্তমান সরকারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা দেখা দিচ্ছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাস নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এ কারণে দেশি-বিদেশি সব ধরনের বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়িয়েছেন। যার ফলে শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়েছে।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আবদুর রাজ্জাক বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে এখন সবাই আতঙ্কিত। বড় ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন না। তাদের নীরব থাকা বাজারে আরও আতঙ্ক বাড়াচ্ছে।

তবে তিনি মনে করেন, করোনাভাইরাসের কারণে এক ধরনের আতঙ্ক থাকলেও আমাদের সন্দেহ একটি গ্রুপ বাজারে এই আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। তারা শেয়ারের দরপতন ঘটিয়ে শেয়ার কেনার পায়তারা করছে।

শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমরান হাসান বলেন, পুঁজিবাজার আর কত পতন হবে। এখন পতন হওয়ার কোন কারন দেখছি না। কেন এভাবে পড়ছে, বলতে পারছি না।

পুঁজিবাজারে কেন এই দরপতন এমন প্রশ্নে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি সাইদুর বলেন, পুঁজিবাজারে বড় দরপতনের কোন কারন নেই।কিছুই বুঝতে পারছি না ভাই; এত কিছুর পর কেন পতন হচ্ছে বাজারে? কী বলব, আমার কোনো মন্তব্য নেই।”

ডিএসইর সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, পুঁজিবাজারের আচরনে আমরা হতাশ ভাই। জানি না কী হচ্ছে।
“বড় ধসের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাজারের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তারপরও বড় পতন হচ্ছে। বিষয়টি পরিষ্কার না।”

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ‘কারোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিশ্ব শেয়ারবাজারে দরপতন হয়েছে। পাকিস্তান শেয়ার মার্কেট বন্ধ করে দিয়েছে। গতকাল (রোববার) করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হওয়ার পর মুজিববর্ষের প্রোগ্রাম পুনর্বিন্যাস করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।’

‘শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। যে কারণে আজ শেয়ারবাজারে বড় দরপতন দেখা যাচ্ছে। করোনা আতঙ্ক ছাড়া এই মুহূর্তে শেয়ারবাজারে দরপতন হওয়ার কোনো কারণ নেই’, বলেন এই শেয়ারবাজার বিশ্লেষক।

বিদেশিদের পোর্টফোলিও নিয়ন্ত্রণ করেন এমন একটি ব্রোকারেজ হাউসের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, করোনা আতঙ্কে এতদিন বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করেছেন। কিন্তু এখন দেশি-বিদেশি সব ধরনের বিনিয়োগকারীরা করোনা আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করছেন।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিদেশিদের থেকে দেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বেশি সেল করার প্রেসার আসছে। বিদেশিরা হয়তো ১০-১৫টি কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করছেন। কিন্তু দেশি বিনিয়োগকারীরা প্রায় সব ধরনের শেয়ার বিক্রির হিড়িক লাগিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে বাজারে বড় ধরনের পতন হয়েছে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, সোমবার লেনদেনের শুরুতেই শেয়ারবাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। লেনদেনের প্রথম ঘণ্টাতেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক ২০০ পয়েন্টের ওপরে পড়ে যায়। সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে পতনের মাত্রা। সেই সঙ্গে দরপতন হতে থাকে একের পর এক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের।

এতে দিনভর ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া মাত্র ২টি প্রতিষ্ঠান শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৩৫২টির। আর ১টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। দেশের শেয়ারবাজারে সাম্প্রতিককালে এমন ভয়াবহ দরপতন দেখা যায়নি।

এই ভয়াবহ পতনের কারণে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ২৭৯ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৮ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। প্রধান মূল্য সূচক হিসেবে ডিএসইএক্স চালুর পর সূচকটির এত বড় পতন আর হয়নি। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচকটি শুরুরও নিচে নেমে গেল। ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক হিসেবে ডিএসইএক্স ৪ হাজার ৫৫ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি।

প্রধান মূল্য সূচকের পাশাপাশি করুণ দশা বিরাজ করছে ডিএসইর অপর সূচকগুলোর। বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচকটি কমেছে ৮৮ পয়েন্ট। ১ হাজার ৪৬০ পয়েন্ট নিয়ে ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি চালু হওয়া সূচকটি এখন ১ হাজার ৩৪৬ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

ডিএসইর আর একটি সূচক ‘ডিএসই শরিয়াহ্’। ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি এ সূচকটি যাত্রা শুরু করে। শুরুতে এ সূচকটি ছিল ৯৪১ পয়েন্টে। সোমবার লেনদেন শেষে সূচকটি ৬৯ পয়েন্ট কমে ৯২৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

ডিএসইতে ১২৪টি প্রতিষ্ঠানের দাম কমেছে ৯ শতাংশের ওপরে। দফায় দফায় দাম কমিয়ে অনেক বিনিয়োগকারী এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি। ২০১০ সালের মহাধসের পর দেশের শেয়ারবাজারে এমন নাজুক অবস্থা আর দেখা যায়নি। শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধস হলেও লেনদেনের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। দিনভর ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৪৯৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৪২৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা। সে হিসাবে লেনদেন বেড়েছে ৭০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।

অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৭৫৫ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৩৪৩ পয়েন্টে। লেনদেন হয়েছে ৭০ কোটি ২০ লাখ টাকা। লেনদেন অংশ নেয়া ২৫৬ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাম বেড়েছে তিনটির, কমেছে ২৪৯টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে চারটির।