মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আজিজ মোহাম্মদ ভাই। কখনও চলচ্চিত্রের রঙিন দুনিয়ায় প্রভাবশালী প্রযোজক। কখনও শিল্পপতি-ব্যবসায়ী। আবার কখনও মাফিয়া ডন। এমনকি জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ ও সোহেল চৌধুরী হত্যাকান্ডের তার জড়িত থাকারও অভিযোগ ব্যাপকভাবে গুঞ্জরিত হয়। এসব মিলিয়ে রহস্যময় এই ব্যক্তি বিগত প্রায় তিন যুগ ধরেই ব্যাপক বিতর্কিত বা আলোচিত নাম। কিন্তু এত অভিযোগের পরও তিনি রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলায় বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে শেয়ারবাজার বিষয়ক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল।

কিন্তু দীর্ঘদিনেও তাকে গ্রেফতারে তেমন কোনো উদ্যোগই লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি নিজ কোম্পানি অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার কেলেংকারির মামলার আসামি। দীর্ঘদিন পর্যন্ত আদালতে হাজির না হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. আকবর আলী শেখ গত বছর এ আদেশ দেন। একই দিন মামলাটির চার্জ গঠন করা হয়েছে। মামলার বাদী শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এদিকে হঠাৎ আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ক্যাসিনো কারবারের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন গত রবিবার বিষয়টি দেশ প্রতিক্ষণকে নিশ্চিত করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ক্যাসিনো কারবারের মাধ্যমে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের অর্জিত সম্পদের তথ্য জানতে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবের তথ্য এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে আয়কর বিবরণী সংগ্রহ করেছে কমিশন। শিগগিরই তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলবি নোটিস পাঠানো হবে।
দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজিজ মোহাম্মদ ভাই বর্তমানে দেশে নেই। তার আয়ের অধিকাংশ অদৃশ্য ও জ্ঞাতআয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে তার পরিবারের ‘বিপুল সম্পদ’ রয়েছে। সেগুলোর খোঁজখবর নিচ্ছে কমিশন।

গত বছর ১৭ অক্টোবর রাজধানীর গুলশানে আজিজ মোহাম্মদের বাসায় অভিযান পরিচালনা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তারা জানান, গুলশান-২-এর ৫৭ নম্বর রোডের ১১/এ এবং ১১/বি নম্বর দুটি ভবনে একযোগে অভিযান চালানো হয়। এর মধ্যে ১১/এ ভবনের ছাদে ছিল মদের মিনিবার। সেখানে আলমারিতে বিপুল পরিমাণ মদ পাওয়া যায়। বিভিন্ন কক্ষে সিসাবারের সরঞ্জাম এবং ক্যাসিনোতে ব্যবহৃত কয়েন, কার্ড ও ঘুঁটি পাওয়া যায়।

অন্য ভবনের চারতলার একটি কক্ষেও পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণ মদ, সিসা ও বিয়ার। সেদিন নবীন ম-ল ও পারভেজ নামে বাড়ির দুই তত্ত্বাবধায়ককে গ্রেপ্তার করা হয়। গুলশানের বাড়ি দুটি দেখাশোনা করতেন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ভাই রাজা মোহাম্মদের ছেলে আহাদ মোহাম্মদ ও ওমর মোহাম্মদসহ কয়েক স্বজন। সেদিন তাদের আটক করা সম্ভব হয়নি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক খুরশিদ আলম জানান, অভিযানের পর তারা দুটি মামলা করেছেন। সেগুলো দুজন পরিদর্শক তদন্ত করছেন। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাড়ির দুই কেয়ারটেকারকে মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অন্য দুই আসামি আজিজ মোহাম্মদের দুই ভাতিজাকে গ্রেপ্তারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তৎপরতা অব্যাহত আছে। এ দুই মামলার কোনোটিতে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে আসামি করা হয়নি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, আজিজ মোহাম্মদের গুলশানের দুই বাড়িতেই ক্যাসিনো খেলা হতো মার্কিন ডলার দিয়ে। এক সেন্ট থেকে একশ ডলার সমমানের কয়েন পাওয়া যায়। এ কয়েন দিয়েই খেলা চলত। খেলা শেষে কয়েনের বিপরীতে ডলার দেওয়া হতো। সেখানে ‘হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিদের’ যাতায়াত ছিল।
দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজিজ মোহাম্মদ ভাই ‘অঢেল সম্পদের’ মালিক।

তার ১১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে অলিম্পিক ব্যাটারি, অলিম্পিক বলপেন, অলিম্পিক ব্রেড ও বিস্কুট, এমবি ফার্মাসিটিউক্যাল, এমবি ফিল্ম ইত্যাদি। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং ও সিঙ্গাপুরে রয়েছে তার হোটেল ও রিসোর্ট ব্যবসা। বাংলাদেশে মাদক কারবারেও তার সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। ১৯৯৬ সালে প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। গুলশানের বাড়িতে অভিযানের দুদিন আগেই দেশ ছাড়েন তার ভাতিজা আহাদ। অভিযানের পর থেকে আত্মগোপনে অন্য ভাতিজা ওমরও।

আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ভাগ্নে আমিন হুদা মাদক মামলায় ৭৯ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি। কারাবন্দি থাকা অবস্থায় গত শুক্রবার (৬ মার্চ) তিনি মারা যান।
উল্লেখ্য, আজিজ মোহাম্মদ ভাই বাংলাদেশের বড় একজন শিল্পপতি ও চলচ্চিত্র প্রযোজক। ৫০টির বেশি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন তিনি। তিনি অলিম্পিক ব্যাটারী, অলিম্পিক এনার্জি প্লাস বিস্কুট, অলিম্পিক বলপেন, অলিম্পিক ব্লেড, এমবি ফার্মা, টিপ বিস্কুট এবং এমপি ফ্লিমসহ আরও কয়েকটি কোম্পানির মালিক। বর্তমানে সপরিবারে তিনি ব্যাংককে রয়েছেন।

১৯৪৭ এ দেশভাগের পর তাদের পরিবার ভারতের গুজরাট থেকে বাংলাদেশে আসে। ওই পরিবার মূলত পারস্য বংশোদ্ভূত। তারা ‘বাহাইয়ান’ সম্প্রদায়ের লোক। ‘বাহাইয়ান’ কে সংক্ষেপে ‘বাহাই’ বলা হয়। উপমহাদেশের উচ্চারণে এই ‘বাহাই’ পরবর্তীতে ‘ভাই’ হয়ে যায়। ধনাঢ্য এই পরিবার পুরান ঢাকায় বসবাস শুরু করে। ১৯৬২ সালে আজিজ মোহম্মদ ভাইয়ের জন্ম হয় আরমানিটোলায়। মামলার বিবরণ থেকে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়ে টাকা হাতিয়ে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ।
এক্ষেত্রে ১০০ টাকার শেয়ারের বিপরীতে ২০০ প্রিমিয়াম নিয়ে রাইট শেয়ার ইস্যু করে অলিম্পিক।

ওই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ২০০। কিন্তু ২০০ টাকা প্রিমিয়ামে মাত্র ৩১ হাজার ৫৯০টি রাইট শেয়ারের আবেদন জমা পড়েছিল। বাকি ১ লাখ ৩ হাজার ৬১০টি শেয়ারের বিপরীতে কোনো আবেদন জমা পড়েনি। অর্থাৎ ওইভাবে রাইট শেয়ারের যে মূল্য ধরা হয়েছিল, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তা গ্রহণ করেনি। এরপরও কয়েক দফা বোনাস শেয়ার দিয়ে শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে ১৯৯৬ সালের ৩০ জুন অলিম্পিকের প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৫৪৯ টাকা।

এরপর মাত্র সাড়ে ৪ মাসের ব্যবধানে একই বছরের ১৬ নভেম্বর তা ৪ হাজার ৪৭৫ টাকায় উন্নীত হয়। এ হিসাবে আলোচ্য সময়ে শেয়ারের দাম বেড়েছে সাড়ে ৮ গুণ। পরবর্তীতে একই মালিকের প্রতিষ্ঠান এমবি ফার্মা উচ্চ দামে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা নিয়ে যায়। এরপর আবার কমতে থাকে শেয়ারের দাম। মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে প্রতিটি শেয়ারের দাম কমে ১ হাজার ৪০ টাকায় নেমে আসে।

এই ঘটনায় কোম্পানি এবং আরও দুই ব্যক্তিকে আসামি করে ১৯৯৯ সালে মামলা দায়ের করা হয়। অন্য আসামিরা হলেন কোম্পানির উদ্যোক্তা মোহাম্মদ ভাই ও আজিজ মোহাম্মদ ভাই। এর আগে ৭ আগস্ট মামলাটির চার্জ গঠনের জন্য পূর্বনির্ধারিত থাকলেও তা পিছিয়ে ২৯ আগস্ট করা হয়েছিল। ওইদিন বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষের সময় আবেদনের প্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে এবং ২৯ আগস্ট দিন ধার্য করেছিল।

গত বছর মামলাটিতে চার্জ গঠন হলেও আসামি আজিজ মোহাম্মদ ভাই ট্রাইব্যুনালে অনুপস্থিত ছিলেন। এক্ষেত্রে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের আইনজীবী বোরহান উদ্দিন ও মোশাররফ হোসেন কাজল উপস্থিতির জন্য জন্য সময় আবেদন করেন। তবে ট্রাইব্যুনাল তা নাকচ করে দিয়ে ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছে। যা মতিঝিল থানা বরাবর করা হয়েছে। এ মামলাটির আসামিরা হলেন অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজসহ মোহাম্মদ ভাই ও আজিজ মোহাম্মদ ভাই।

এর মধ্যে মোহাম্মদ ভাই চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি মারা গেছেন। ওইদিন (২৪ জুলাই) আসামিদের আইনজীবী বোরহান উদ্দিন ট্রাইব্যুনালে মোহাম্মদ ভাইয়ের মৃত্যুর সনদ দাখিল করেন। এর আলোকে মোহাম্মদ ভাইয়ের মৃত্যুর সত্যতা যাছাইয়ে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশকে ট্রাইব্যুনাল নির্দেশ দিয়েছিল। যার মৃত্যুর সত্যতা আছে বলে ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করেছে সংশ্লিষ্ট পুলিশ। গত বছরের ৩০ নভেম্বর উচ্চ-আদালত অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলাটির স্থগিতাদেশ বাতিল করে।

বিচারক এম এনায়েতুর রহিম ও শহিদুল করিমের দ্বৈত বেঞ্চ এই বাতিলের আদেশ দেন। ২০১৩ সাল থেকে স্থগিত রয়েছে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার কেলেঙ্কারির মামলাটি। ১৯৯৯ সালে দায়েরকৃত মামলাটি ২০১৫ সালে শেয়ারবাজার বিষয়ক ট্রাইব্যুন্যালে স্থানান্তরিত হয়েছে। তবে উচ্চ-আদালতের নির্দেশে এতদিন মামলাটির বিচারকাজ বন্ধ ছিল।
ওয়ান-ইলেভেনের পর বিদেশে পাড়ি জমানো আজিজ মোহাম্মদ ভাই বর্তমানে থাইল্যান্ডে অবস্থান করছেন।

থাইল্যান্ডসহ দুবাই, ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুরে রয়েছে তার হোটেল, বার ও রিসোর্ট ব্যবসা। বাংলাদেশেও অলিম্পিক ব্যাটারি, অলিম্পিক বলপেন, অলিম্পিক ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট, এমবি ফার্মাসিউটিক্যালস ও এমবি ফিল্মসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের মালিক আজিজ মোহাম্মদ ও তার পরিবার। আজিজ মোহাম্মদ ভাই দীর্ঘ সময় ধরেই বিদেশে থাকলেও তার স্ত্রী নওরীন মাঝেমধ্যে দেশে আসেন।

অনেকেই বলেছেন, আজিজ মোহাম্মদ ভাই বিদেশে থাকলেও দেশের চলচ্চিত্র, মাদক সাম্রাজ্য ও ক্যাসিনোসহ নানা ক্ষেত্রে তার পরোক্ষ সক্রিয়তা রয়েছে। আন্ডার ওয়ার্ল্ডের মাফিয়া ডন ভারতীয় নাগরিক দাউদ ইব্রাহিমের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে নিয়ে রয়েছে চিত্রজগতের নানা চাঞ্চল্যকর গুঞ্জন। এর মধ্যে গুরুতর অভিযোগ হিসেবে রয়েছে চিত্রনায়ক সালমান শাহ ও সোহেল চৌধুরী হত্যাকান্ডের নেপথ্যে তার জড়িত থাকার অভিযোগ।