মিজানুর রহমান,  দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : পুঁজিবাজারে দুরবস্থায় পড়েছে ব্যাংকিং খাত। ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। আগে যেখানে মোট পুঁজিবাজার মূলধনের ৪০ ভাগের ওপরে দখলে ছিল এ খাতের, এখন সেটা কমতে কমতে ২০ ভাগের নিচে নেমে গেছে। শুধু তা-ই নয়, অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে আট ব্যাংকের শেয়ার। ব্যাংকিং খাতের এ দুরবস্থার জন্য এ খাতের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব দেখা দেয়া অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তাদের মতে, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংক, এনন টেক্স, ক্রিসেন্টের মতো বড় বড় ঋণকেলেঙ্কারির ঘটনা যখন বিনিয়োগকারীরা জানতে পারেন, পরিচালকদের নিজ ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার ঘটনা যখন ঘটে, খেলাপি ঋণ যখন ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, তখন শঙ্কিত হয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা।

বিনিয়োগ করে মূলধন হারানোর আতঙ্ক থেকে এ খাতের ওপর মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের ব্যাংকের শেয়ার মূল্যের ওপর।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য যখন ১০ টাকা, সেখানে আটটি ব্যাংকের শেয়ার মূল্য ১০ টাকার নিচে নেমে গেছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ও স্টান্ডার্ড ব্যাংক রয়েছে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আকতার হোসেন সান্নামাত বলেন, কোনো কোম্পানির ওপর যখন বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়, তখন বিনিয়োগকারীরা ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। অর্থাৎ, বিনিয়োগকারী যখন বুঝতে পারেন সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে তার বিনিয়োগ তুলতে পারবেন না, তখন ওই কোম্পানিতে আর শেয়ারে বিনিয়োগ করেন না। এতে ওই কোম্পানির মূল্য কমে যায়। ব্যাংকিং খাতে শেয়ারের মূল্য কমে যাওয়া এটাই অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন এ অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।

তিনি জানান, দেশের পুঁজিবাজারের মোট বাজার মূলধনের ৪০ ভাগের ওপরে দখলে ছিল ব্যাংক কোম্পানির শেয়ার। এখন তা কমতে কমতে ২০ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার জন্য নানা কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে ঘন ঘন নীতিমালা শিথিল করা। ২০১৫ সালে ঋণপুনর্গঠনের নামে মাত্র ১ ও ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নবায়ন করা হয়। এর বাইরেও ওই সময়ে অনেক ব্যাংকেরই ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়।

এতে রাতারাতি খেলাপি ঋণ কমে গেলেও আবার ঋণখেলাপিরা এ সুযোগ নিয়ে নতুন করে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। কিন্তু নবায়ন করা ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় আবার তা নতুন করে খেলাপি হয়। এভাবেই গত কয়েক বছর যাবৎ ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেয়ায় ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অনেক ভালো ঋণগ্রহীতা।

এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের শুরুতেই ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের ঘোষণা দেয়া হয়। এতে সুদের হারেও ছাড় দেয়া হয়। এ সুবিধার আওতায় ১০ বছর মেয়াদি ঋণ নবায়নের সুযোগ নিতে ঋণ পরিশোধ অনেকাংশেই বন্ধ করে দেন বড় বড় ঋণগ্রহীতারা। এর পরেও গত সেপ্টেম্বর শেষে ঋণ অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকায়।

যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের হিসাবে তা প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। সবমিলে ব্যাংকের নগদ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়ে।

ব্যাংকাররা মনে করেন, সামনে এ আয়ের ওপর আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর হলে ব্যাংকগুলোর আয় আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ওপর।

এদিকে দেশের পুঁজিবাজারে ব্যাংক খাতের মৌলভিত্তি সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এর ফলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগে তুলনামূলক কম ঝুঁকি থাকে। কিন্তু ২০১০ সালের বাজার ধসের পর থেকেই এ খাতের প্রতিষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় বিনিয়োগকারীরা।

আর ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো এর পর থেকেই বাজার ধসের চাপ সামাল দিতে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে বাজার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করে। যার প্রভাবে গত ৫/৬ বছর ধরে ব্যাংক খাতের শেয়ারে মন্দাবস্থা বিরাজ করছিল। বিশেষ করে ২০১৮ সালের পর থেকে ব্যাংক খাতের শেয়ারে সবচেয়ে বেশি দরপতন হয়েছে। তবে ব্যাংক খাতের বড় ঝড়ের মধ্যে ঢাকা ব্যাংকের ইপিএস বড় পতন দেখা দিয়েছে।

গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৮-১৯ সালে সর্বনিন্ম ইপিএস হয়েছে। ২০১৪ সালে যেখানে ঢাকা ব্যাংকের ইপিএস ছিল ৩ টাকা ৬৯ পয়সা ২০১৮ সালে কোম্পানিটির ইপিএস দাঁড়ায় ১ টাকা ৭৩ পয়সা। ব্যাংক খাতের অন্যান্য কোম্পানির ন্যায় ঢাকা ব্যাংকের অবস্থা কিছুটা নাজুক রয়েছে। তবে প্রতি বছর ব্যাংকটি ১০ শতাংশ ঘরে ডিভিডেন্ড দিয়ে যাচ্ছে।

তাছাড়া পুঁজিবাজারের যেকোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগের পূর্বে ওই কোম্পানির সার্বিক অবস্থা জেনে নেয়া উচিত। এ জন্য অবশ্যই কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস), শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভি), মূল্য আয়ের আনুপাতিক হার (পিই রেশিও) সম্পর্কে জানতে হবে। বিনিয়োগের পূর্বে এসব বিষয় না জানলে কোম্পানিটির প্রকৃত অবস্থা জানতে বা বুঝতে পারবেন না সাধারন বিনিয়োগকারীরা। বিশেষ করে যে কোম্পানির

পিই রেশিও যত কম থাকবে, সেই কোম্পানিটি বিনিয়োগের জন্য তত ভালো। সাধারনত ৪০ পিই রেশিও স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই মানের উপরে থাকলে সেই কোম্পানিতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ বলে গণ্য হবে।

পিই রেশিও থেকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য। এই মূল্যটি যত বেশি থাকবে বিনিয়োগের জন্য ততই ভালো। তাই বিনিয়োগের পূর্বে সেই কোম্পানির খুঁটিনাটি ভালোভাবে জানা খুবই জরুরি।

পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড। এই ব্যাংকটির অনুমোদিত মুলধন ১ হাজার কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৮৫৩ কোটি ২১ লাখ ২০ হাজার টাকা। কোম্পানিটির পুঞ্জিভূত আয় রয়েছে ৮৭১ কোটি ৬৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। ব্যাংকটি গত এক মাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর ৯ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৪০ পয়সায় উঠানামা করে। অপরদিকে, গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ারদর ৯ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ১৫ টাকা ৮০ পয়সায় উঠানামা করে।

গত ৫ বছরে কোম্পানিটির লভ্যাংশ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ১০ শতাংশ বোনাস, ২০১৫ সালে ১০ শতাংশ বোনাস ও ৬ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ, ২০১৬ সালে ১০ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস, ২০১৭ সালে ১২.৫ শতাংশ বোনাস এবং ২০১৮ সালে ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ প্রদান করে।

গত ৫ বছরে কোম্পানিটির ইপিএস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ইপিএস ছিল ৩ টাকা ৬৯ পয়সা, ২০১৫ সালে ২ টাকা ৪২ পয়সা, ২০১৬ সালে ছিল ২ টাকা ২৬ পয়সা, ২০১৭ সালে ছিল ২ টাকা ২৩ পয়সা এবং ২০১৮ সালে কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ১ টাকা ৭৩ পয়সা।

অপরদিকে, গত ৫ বছরের শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য বা এনএভি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে কোম্পানিটির এনএভি ছিল ২২ টাকা ৮২ পয়সা, ২০১৫ সালে ২১ টাকা ৮৯ পয়সা, ২০১৬ সালে ২১ টাকা ৬৮ পয়সা, ২০১৭ সালে ২১ টাকা ৯১ পয়সা এবং ২০১৮ সালে ছিল ২১ টাকা ২৩ পয়সা ।

ডিএসই’র তথ্য মতে, কোম্পানিটির ৫ বছরের পিই রেশিও পর্যালোচনা করে দেখা যায় ২০১৪ সালে পিই রেশিও ছিল ৫.৪৫, ২০১৫ সালে ৮.১৪, ২০১৬ সালে ছিল ৭.৯২, ২০১৭ সালে ৯.৮৮ এবং ২০১৮ সালে ছিল ৮.১৯ শতাংশ।

ঢাকা ব্যাংক লিমিটেডের মোট শেয়ার সংখ্যা ৮৫ কোটি ৩২ লাখ ১১ হাজার ৮১৯ টি। এর মধ্যে উদ্যোক্তা বা পরিচালকের হাতে রয়েছে ৪০ দশমিক ৬২ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ১৩ দশমিক ০৫ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৪৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ শেয়ার।
ক্রেডিট রেটিংয়ে দীর্ঘ মেয়াদে হয়েছে ‘এএ’ এবং স্বল্প মেয়াদে হয়েছে “এসটি ২”।

কোম্পানিটির সর্বশেষ কোয়াটার অর্থাৎ তৃতীয় প্রান্তিকে ৩ মাসে (জুলাই- সেপ্টেম্বর,১৯) কনসোলিটেড অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ৪৭ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে আয় ছিল ৫০ পয়সা।

৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর,১৯) কোম্পানিটির কনসোলিটেড শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ১ টাকা ২৪ পয়সা, যা আগের বছর একই সময়ে আয় ছিল ১ টাকা ২০ পয়সা। এ সময় কনসোলিটেড নেট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো পার শেয়ার ( এনওসিএফপিএস ) আয় হয়েছে ৮ টাকা ৫২ পয়সা, যা আগের বছর একই সময়ে এনওসিএফপিএস লোকসান হয়েছিল ২ টাকা ৯৩ পয়সা।

এছাড়া ৩০ সেপ্টেম্বর,১৯ শেষে কোম্পানিটির কনসোলিটেড শেয়ারপ্রতি প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) হয়েছে ২০ টাকা ৯৬ পয়সা যা আগের বছর একই সময়ে ছিল ১৯ টাকা ৭৫ পয়সা। ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড ২০০০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে বর্তমানে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে।