অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল): করোনা স্থবির করে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে সব ধরণের সামাজিক যোগাযোগ। কোভিড-১৯ আতঙ্কে কাপছে বাংলাদেশও। যদিও বাংলাদেশে সংক্রমণ এখনো কম, তবু বিপুল ঘনবসতির এই দেশে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। পাচজন এরই মধ্যে মারা গেছেন। এর শেষ কোথায় এটা এখন বোধহয় কেউ বলতে পারবেন না। আমিও পারবো না। তবে এটুকু বলতে পারি শেষটা অবশ্যই হবে। এটা এমন কোন জিনিস না যে এটা দিয়ে মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে।

কতগুলো বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাড়িয়ে এ কথা বলা যায়। ভ্যাকসিন তৈরীর কাজ চলছে। ছয় মাসে না হোক ভ্যাকসিন চলে আসবেই। দ্বিতীয় বিষয় হলো এই ভাইরাসে মানুষ কেন অসুস্থ হচ্ছে বা মারা যাচ্ছে? কারণ এটি আমাদের জন্য নতুন একটি ভাইরাস। এর বিরুদ্ধে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল না। যখন আস্তে আস্তে অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়ে যাবেন তখন আশেপাশের আরো অনেক মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী হবে। এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সারা জীবন স্থায়ী হবে, নাকি কয়েক মাস বা কয়েক সপ্তাহ সেটা আমরা জানি না। কারণ ভাইরাসটাই নতুন।

কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অবশ্যই তৈরী হবে। যখন সংক্রমিত হওয়ার কারণে দশ জন মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী হবে তখন আশেপাশের আরো পাচ-সাত জনের মধ্যেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ডেভেলপ করবে।

এটাকে হার্ড ইমিউনিটি বলে। একটা সময় আসবে যখন এই ভাইরাসটা আমাদের আশেপাশেই থাকবে কিন্তু হার্ড ইমিউনিটির কারণে বা ভ্যাকসিনের কারণে এটি নতুন করে আর আমদের সংক্রমিত করতে পারবে না। ফলে একটা পর্যায়ে এটি থামাতে বাধ্য হবে। সেটা কবে হবে তা অবশ্য আমরা হলফ করে বলতে পারি না। তবে যত তাড়াতাড়ি থামবে ততই মঙ্গল।

তবে মানুষকে আশ্বস্ত করার জায়গাটা হলো এই যে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সবাই কিন্তু মৃত্যুবরণ করবেন না। শতকরা ৮০-৮৫ জনের কোন উপসর্গই থাকবে না। ১০-১৫ শতাংশ মানুষের উপসর্গ দেখা দিবে আর তাদের মধ্যে অল্প কিছুসংখ্যক মৃত্যুবরণ করবেন। এটাই বাস্তবতা। রোগটি খুব বেশী ছোয়চে হলেও একটু সচেতনতা আর সতর্কতা এর মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে পারে।

অনেকের মনে প্রশ্ন করোনা নিয়ে আমাদের সরকারের প্রস্তুতিটা কেমন? এটি আসলেই যে কেমন, তা কিন্তু শুধু তখনই জানা যাবে যদি ¯্রষ্টা না করুন করোনার ধাক্কাটা জোরে-সোরে আমাদের উপর এসে পরে। প্রত্যেক দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকারই তার নাগরিকদের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ সরকারও এর বাইরে না। মনে রাখতে হবে এক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় বরাদ্দ দেওয়ার পরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে যাচ্ছে করোনার পরবর্তী এপিসেন্টার আর সম্ভাব্য সব প্রস্তুতি নেওয়ার পরও ইটালী আর স্পেনে মৃতের সংখ্যা পেছনে ফেলেছে চীনকে।

অন্যদিকে ভুটানে আক্রান্ত একজন আর নেপাল মারা যাননি কেউই। অনেক শক্তিশালী আর উন্নত দেশ যা করতে পারেনি তাই করে দেখিয়েছে অনেক ছোট দেশও। কাজেই শুধু সরকারের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে বসে থাকলে হবে না, নিজেদের কাজটাও ঠিকঠাক মত করতে হবে। আর গত কদিনে এই জায়গাটাতেই বোধহয় আমরা খুব বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারিনি।

চীন থেকে যেসব দেশী-বিদেশী নাগরিককে দেশ ত্যাগের অনুমতি দেয়া হয়েছিল, তাদের সবাইকে চীনে কোয়ারেন্টাইন করে বিমানে উঠতে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তেমনটা করেনি ইটালী। পাশাপাশি উহান থেকে প্লেন বোঝাই করে যে বাংলাদেশীদের উড়িয়ে আনা হয়েছিল, তাদের আমরা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখতে পেরেছিলাম। এমনকি যেসব বাংলাদেশী ছাত্র ভারত হয়ে উহান থেকে দেশে এসেছিলেন তাদরেকেও ভারত সরকার ভারতে কোয়ারেন্টাইন শেষেই দেশে পাঠিয়েছিল।

পাশাপাশি উহানের যে বাংলাদেশীদের বসবাস তারা মূলতঃ ছাত্র ও শিক্ষক। তাদের মধ্যে আন্তঃ যোগাযোগ খুব বেশী না। অন্যদিকে ইটালীর ব্যাপারটা সম্পুর্নই ভিন্ন। সেখানে বসবাস ছয় লক্ষাধিক বাংলাদেশীর। কি নেই তাদের সেখানে? রেষ্টুরেন্ট আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানতো বটেই, আছে এই জেলা আর ঐ উপজেলা সমিতি আর সংঘও। তাছাড়া এসব বাংলাদেশীদের ওখানকার স্থানীয়দের সাথে মেলামেশাটাও উহানের বাংলাদেশীদের তুলনায় অনেক বেশী।

সঙ্গত কারণেই করোনার এপিসেন্টারটা চীন থেকে ইউরোপে স্থানান্তরিত হওয়ার পর যখন দলে-দলে প্রবাসী ইটালী থেকে দেশে আসতে শুরু করলেন, তখন আমরা হয়ত এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করতে না পেরে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছিলাম। আমরা হয়ত বুঝে উঠতে পারিনি চীন আর ইটালী ফেরত প্রবাসীদের মধ্যকার এই পার্থক্যগুলো। তাছাড়া হোম কোয়ারেন্টাইনতো এধরণের প্যান্ডেমিকে ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সমিশন ঠেকানোর একটা প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিও বটে।

কিন্তু আমাদের প্রবাসী ভাই-বন্ধুদের নাগরিক দায়-দায়িত্বটা কোথায় হারিয়ে গেল? একটি উন্নত দেশ থেকে আসার পরও হোম কোয়ারেন্টাইনের সংজ্ঞা না মেনে তারা ঘুরছেন-ফিরছেন, সামাজিকতা করছেন, এমনকি বিয়ে-শাদীও করছেন কেউ-কেউ! দেশে ফিরে কেন দেশটাকে এমন অনিরাপদ বানালেন তারা?

আর শুধু প্রবাসীদেরই বা দুষবেন কেন। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সরকারের ঘোষিত ১০ দিনের ছুটিকে ঈদের ছুটি বানিয়ে যারা হাজারে-হাজারে, কাতারে-কাতারে দেশের বাড়িতে ছুটলেন, বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুতে তৈরী করলেন ১৫ কিলোমিটার ট্রাফিক জ্যাম, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন আর সবকিছু বাদ দেন, যে পরম নিকটজনদের সাথে ছুটি কাটানোর উদ্দেশ্যে আপনাদের এই ঢাকা ত্যাগ, আপনাদের কারণে কত বেশী অনিরাপদ হয়ে পড়লেন তারা।

আজকে এই মুহুর্তে দাড়িয়ে যদি আমাকে প্রশ্ন করেন আমদের এখন করণীয়টা তাহলে কি, আমার উত্তরটা হবে ছোট – আমাদের এই সংকটকে অবশ্যই সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে নিতে হবে, কিন্তু কোনভাবেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না কারণ আতঙ্কিত ব্যাক্তি কখনোই ঠান্ডা মাথায় সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারেন না।

আমরা যদি সরকারের উপর আস্থা রেখে সরকার বাতলে দেওয়া নিয়ম-কানুনগুলো ঠিকঠাক মত মেনে চলি তাহলে করোনা আমাদের কাবু করতে পারবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে তার ভাষণে এই কথাগুলোর উপর জোর দিয়েছেন। আমার উত্তরটাও আমি তার কাছ থেকেই ধার করে দিলাম।

লেখক: চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ