দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ আজ বুধবার (১ এপ্রিল) থেকে কার্যকর হচ্ছে। ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণের ক্ষেত্রে এ সুদহার কার্যকর হবে। এটি কার্যকর করতে ব্যাংকগুলো গত জানুয়ারি থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, করোনা ভাইরাসের আক্রমণে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তা মোকাবিলায় সিঙ্গল ডিজিট সুদহার কার্যকরের এখনই উপযুক্ত সময়।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ৯ শতাংশ সুদ বেঁধে দিয়ে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সার্কুলারে বলা হয়, ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৯ শতাংশ। এ ছাড়া ঋণটি খেলাপি হলে অতিরিক্ত ২ শতাংশ সুদ আরোপ করতে পারবে। তবে আমানতের সুদহার নিয়ে কোনো সার্কুলার জারি করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংকগুলো নিজেদের মতো আমানতের সুদ অফারের সুযোগ পাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আজ থেকে ব্যাংকগুলোকে সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার কার্যকর করতে হবে। করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনীতিতে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। এটি কাটিয়ে উঠতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নানা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক মালিকদের মুনাফার দিকে না তাকিয়ে অর্থনীতির স্বার্থে এটা করা উচিত।

তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাতে বর্তমানে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। যদি কোনো ব্যাংকের তারল্য কম থাকে সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সরকার ৫ হাজার কোটি টাকা বাজারে বিশেষ সহায়তা হিসেবে ছাড়ছে। এ অর্থ অর্থনীতির সঙ্গে যোগ হবে। কোনো অজুহাতেই সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়ন না করার সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে এবিবির চেয়ারম্যান ও বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ১ এপ্রিল থেকে ঋণের সুদ এক অঙ্কে সেট আমরা বাস্তবায়ন করব। এ জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও আছে। তিনি বলেন, এখনো কোনো কোনো ব্যাংকে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশের বেশি রয়েছে, কারও ছয়, আবার কারও সাড়ে ছয় থেকে সাত শতাংশ বা তার বেশি। এটা নিয়ে যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকে কোনো সার্কুলার হয়নি, তাই আমানতের সুদহার ব্যাংক টু ব্যাংক ভ্যারি করবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকগুলো এমনিতেই সংকটে। তারা ৬ শতাংশ সুদে আমানত পাচ্ছে না। কারণ ৬ শতাংশ সুদে আমানত রাখতে মানুষ নিরুৎসাহিত হচ্ছে। আমানতের উৎসে কর ও আবগারি শুল্ক কাটা হয়। এর সঙ্গে বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে তাও ৬ শতাংশের কাছাকাছি। তার মানে যদি কেউ ব্যাংকে টাকা রাখে তা হলে লাভ তো হচ্ছে না বরং ক্ষতির মুখে পড়ছে।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু ব্যাংকগুলো আমানত সেভাবে পাচ্ছে না। আবার ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে তাদের ঋণ ও আমানতের অনুপাত (এডিআর) ঠিকই মেনে চলতে হবে। ফলে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর হলেও তারল্য সংকটে ঋণ বিতরণ ব্যাহত হবে। আবার করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা এখন উৎপাদনে যাচ্ছে না। এরই মধ্যে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষ একসঙ্গে কাজ করতে পারছে না। অনেক শ্রমিকের চাকরি গেছে। ফলে ঋণের চাহিদা কম হবে। অর্থাৎ ছয়-নয় যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল সেটা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকরে ব্যাংকগুলোর কিছুটা সমস্যা হবে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এরই মধ্যে সিআরআর এবং রেপো রেট কমানো হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর কস্ট অব ফান্ড কিছুটা কমবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। করোনার কারণে এখন ব্যবসায়ীদের কম সুদের ঋণ খুব প্রয়োজন। ৯ শতাংশ সুদে ব্যবসায়ীদের কিছুটা হলেও সুবিধা দেবে। পাশাপাশি করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ব্যবসায়ীদের আরও নীতি-সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন বলেও আমি মনে করি।

ব্যাংক মালিকরা নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন ২০১৮ সালের জুনে। কিন্তু সরকারি ব্যাংক এবং কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলো ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামায়নি। অথচ ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যাংকের মালিকরা সরকারের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি সুবিধা আদায় করে। কিন্তু এসব সুবিধা নিয়ে তারা সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামায়নি।

এর পর গত বছরের ১ ডিসেম্বর কমিটি গঠন করে শুধু উৎপাদনশীল খাতের ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ১ জানুয়ারি থেকে বাস্তবায়ন হবে বলেও জানানো হয়। কিন্তু শেষ সময় এসে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার এবং ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী ফেব্রুয়ারিতে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।