দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা:  পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক দরপতনের ফলে আর্থিক খাতের অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার দর তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এসব কোম্পানিগুলোর মধ্যে ১১টির শেয়ার দর বর্তমানে ১০ টাকার নিচে লেনদেন হচ্ছে। কোম্পানিগুলোর শেয়ার দামে বর্তমান বাজারে এ টাকায় চা ছাড়া অন্যকিছু পাওয়া যায় না। সে হিসেবে বর্তমানে পুঁজিবাজারে বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ার চায়ের দরে পাওয়া যাচ্ছে।কারন বর্তমান বাজারে এক কাপ চায়ের দাম ১০ টাকা। সেখানে কিছু কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম ২-৫ টাকার ঘরে।

এছাড়া আমানত, তারল্য, মুনাফা, নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সংকটের মধ্যে রয়েছে দেশের অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। দিন যত যাচ্ছে অব্যাংকিং আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকট তত বাড়ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অর্ধেকের শেয়ার দাম ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে গেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে তারল্য সংকট, আস্থাহীনতা, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও ডিএসইর দ্বন্দ্ব, ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতা, ফোর্সড সেল, আর্থিক খাতের নৈরাজ্য, পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন, বোনাস লভ্যাংশে বিধি-নিষেধ, কারসাজির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া, পেনিক সেলসহ নানা ইস্যুতে পুঁজিবাজারে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

পাশাপাশি জেড ক্যাটাগরির ১৫টি কোম্পানি নিয়ে ডিএসইর তদন্ত, দু’টিকে ডিলিস্টিং, চারটিকে ওটিসিতে নেয়ার চেষ্টা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতাকে আরও উসকে দিচ্ছে, যা ২০১০ সালে ধসের পর এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

তারা বলছেন, লাগাতার দরপতনে দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা। বর্তমানে তারা আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করছেন। বিশেষ করে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। বর্তমান মার্কেটের ওপর বিনিয়োগকারীরা আস্থা রাখতে পারছেন না। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের একটি শেয়ার চকলেটের দরে লেনদেন হওয়াটা আস্থাশীল মার্কেটের বৈশিষ্ট্য নয়। পাশাপাশি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের যথাযথ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। সে জন্য কোম্পানিগুলোর দর তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অধিকাংশ অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ভলো না। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর গ্রাহকের আস্থা নেই। ফলে বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছে। আবার বিতরণ করা ঋণের বড় অংশ খেলাপি হয়ে গেছে। যে কারণে তারল্য সংকটে পড়ে অনেকে গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। সার্বিকভাবে তারল্য ও মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে শেয়ার দামে।

তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তালিকাভুক্ত আটটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান লোকসানের কবলে পড়েছে। মুনাফার দেখা পেলেও আগের বছরের তুলনায় নয়টির মুনাফা কমে গেছে। পরিচালন নগদপ্রবাহ বা ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে ১৪টির। আর সম্পদ মূল্য কমে গেছে ১৫টির। এর মধ্যে একটির সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।

সার্বিকভাবে আমানত, তারল্য, মুনাফা, সম্পদ মূল্য সবক্ষেত্রেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকটের মাত্রা বেড়েছে। মুনাফা, সম্পদ মূল্য অথবা ক্যাশ ফ্লো এই তিনটি সূচকের এক বা একাধিক সূচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ২০টি কোম্পানির। তিন সূচকের কোনোটিতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের।

এমন সংকটে পড়ায় তালিকাভুক্ত ২৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বর্তমানে ১১টির শেয়ার দাম ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে গেছে। এছাড়া আরও পাঁচটির শেয়ার দাম ফেস ভ্যালুর কাছাকাছি অবস্থান করছে। ফেস ভ্যালুর নিচে নেমে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিডি ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি), ফারইস্ট ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ফ্যাস ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, মাউডস ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং, প্রিমিয়ার লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটাল।

এর মধ্যে সব থেকে খারাপ অবস্থায় আছে বিআইএফসি। প্রতিষ্ঠানটি নগদ অর্থ সংকটের পাশাপাশি লোকসানে নিমজ্জিত রয়েছে। এমনকি ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে সম্পদ মূল্য। শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে মাত্র দুই টাকা ৬০ পয়সা।

সব থেকে কম দামে শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের। কোম্পানিটির শেয়ার দাম দাঁড়িয়েছে দুই টাকা ৪০ পয়সা। শেয়ারের দাম এমন করুণ দশায় পতিত হওয়া কোম্পানিটি লোকসানের খাতায়ও নাম লিখিয়েছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে লোকসান হয়েছে ছয় টাকা আট পয়সা। আর শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য দাঁড়িয়েছে মাত্র এক টাকা ১৪ পয়সা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটের মধ্যে আছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়ছে। ঋণাত্মক ক্যাশ ফ্লো হওয়ার কারণ তারা বিতরণ করা ঋণ আদায় করতে পারছে না। তাছাড়া মানুষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্বাস করতে পারছে না, যে কারণে তারা আমানত রাখছে না। অনেকে আমানত তুলে নিচ্ছে।

আর্থিক খাতের এই দুরবস্থা থেকে উঠে আসার উপায় হিসেবে এই বিশ্লেষক বলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে তারল্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে যারা কারচুপি বা দুর্নীতি করেছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সে ম্যানেজমেন্টের লোক হোক বা বোর্ডের লোক হোক সবাইকে আইনের মধ্যে আনতে হবে। পাশাপাশি আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে খারাপ ঋণগুলো সংগ্রহের চেষ্টা করতে হবে। মোটকথা আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। আইনের শাসন না থাকার কারণেই আর্থিক খাতগুলো এ সংকটে পড়েছে।