দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশে প্রথম তিনজন করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। সে হিসেবে রোগটির প্রাদুর্ভাবের আজ ৪৩তম দিন চলছে। এর মধ্যে দেশের সব বিভাগে এবং ৬৪ জেলার মধ্যে ৫২ জেলায় রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড হচ্ছে। মারাও যাচ্ছেন আশঙ্কাজনক হারে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার সারা দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে।

কার্যত লকডাউনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। দমবন্ধ অবস্থা মানুষের। পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্নও। সবার মনে এখন একটিই প্রশ্ন কবে নাগাদ এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মিলবে। কিংবা আর কত রোগী ও মৃত্যু বাড়বে এবং ঠিক কবে নাগাদ সংক্রমণের সংখ্যা সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে পারে।

এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে গতকাল শনিবার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) রোগতত্ত্ববিদ এবং ভাইরোলজিস্টদের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, কবে নাগাদ সংক্রমণের সংখ্যা সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে পারে, সেটার এক ধরনের ম্যাথলজিক্যাল প্যাটার্ন রয়েছে। সেটা নির্ভর করে ‘রিপ্রোডাকশন রেট’-এর ওপর। অর্থাৎ একজন থেকে কয়জনে ছড়াচ্ছে, এ সংখ্যাটা বের করতে পারলেই পিক টাইম ও সংখ্যাটা অনুমান করা যায়। এ ছাড়া ইনকিউবেশন পিরিয়ডের ওপরও নির্ভর করে।

এসব বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশে সব মিলিয়ে দুই ধাপে করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণ হতে পারে। প্রমটি হতে পারে এখন থেকে দেড় মাস বা তার কিছু কম সময়ের মধ্যে, অর্থাৎ মধ্য মে থেকে মে মাসের শেষ নাগাদ। তবে সর্বোচ্চ সংক্রমণ দুই মাসের মধ্যেই ঘটবে। সে হিসেবে মধ্য জুন পর্যন্ত যেতে পারে। অবশ্য এসব কিছুই নির্ভর করছে করোনা নিয়ন্ত্রণে দেশে নেওয়া কর্মসূচিগুলো ঠিক কতটা সঠিকভাবে মানা হয়, সেটার ওপর।

আইইডিসিআর দেশে করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণের একটা ‘প্রেডিকশন মডেল’ ও গ্রাফ তৈরি করেছে বলে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন সেখানকার কয়েক বিশেষজ্ঞ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব বিশেষজ্ঞ জানান, যদিও এটা বলা খুব কঠিন যে, ঠিক কবে নাগাদ সংক্রমণ সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছার পর তা ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। তারপরও তিনটি দিক বিবেচনায় নিয়ে আইইডিসিআর একটি মডেল করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, আরও এক থেকে দেড় মাস, সর্বোচ্চ দু’মাস পর্যন্ত সংক্রমণ বাড়তে পারে।

ধারণা করা হচ্ছে, মধ্য জুনে যেতে পারে। এরপর কমতে থাকবে। করোনা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আইইডিসিআরের এক বিশেষজ্ঞ বলেন, আমরা এখন কন্ট্রোল মেজার, অর্থাৎ সংক্রমণ ধীরগতি করার জন্য কাজ করছি। এতে সংক্রামণ সর্বোচ্চ হলে পরিস্থিতি ম্যানেজ করা সম্ভব হবে। কারণ বাংলাদেশ একবারে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এখানে অনেক ঘাটতি রয়েছে। তাই সংক্রমণ যাতে ধীরে ধীরে বাড়ে, সে জন্যই কাজ করছি। এ থেকে আমাদের ধারণা সর্বোচ্চ সংক্রমণটা মধ্য জুন পর্যন্ত যেতে পারে।

আর করোনা ব্যবস্থাপনা ভালো হয়, তা হলে মে মাসের শেষ নাগাদ সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হতে পারে। এই গবেষক আরও বলেন, দেশে এখন করোনা বাড়ার ট্রেন্ড চলছে। খুব দ্রুত শেষ হবে এটা আশা করা যায় না। তিনটি বিষয়কে মূল ধরে আইইডিসিআর সংক্রমণের মডেল তৈরি করেছে উল্লেখ করে আইইডিসিআরের এক গবেষক বলেন, প্রথমতআমরা দেখছি রোগীর সংখ্যা কী অনুপাতে বাড়ছে।

দ্বিতীয়তরিপ্রোডাকশন রেট, অর্থাৎ একজন থেকে কয়জনে ছড়াচ্ছে। সর্বশেষ রোগটি নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতি কেমন।এই তিন বিষয়ের ব্যাপারে এই গবেষক বলেন, এখনো রোগী বৃদ্ধির আশঙ্কাজনক। তবে রিপ্রোডাকশন রেট আমাদের এখানেও অন্যান্য দেশের মতোই কাছাকাছি ২-৩ জনের মধ্যেই রয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, এটা এখনই বলা খুব কঠিন যে, কতদিন পর্যন্ত সংক্রমণ বাড়বে। এখনো রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সারা দেশ ঝুঁকিপূর্ণ। মানুষ যদি সামাজিক দূরত্ব ও লকডাউন না মানে তা হলে ঝুঁকি আরও বাড়বে। আরও কিছুদিন সংক্রমণও বাড়বে। নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা ঠিক কীভাবে এগোচ্ছে, আমরা ঘরে থাকার ও সুরক্ষার যে পরামর্শ দিচ্ছি, সেটা কতটুকু মানা হচ্ছে, সেটার ওপর করোনা বাড়া-কমা নির্ভর করবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসাবিজ্ঞানী জানান, করোনার ইনকিউবেশন পিরিয়ড সাধারণত গড়ে ১৪ দিন। এর মধ্যে করোনার লক্ষণ-উপসর্গ দেখা দিতে ৭ দিন ও লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর তার সিভিয়ারিটিতে যেতে ১০ দিন লাগে। তবে সিভিয়ারিটিতে যেতে সর্বোচ্চ ২০ দিন পর্যন্ত লাগতে পারে। অবশ্য ১৫ দিনের মাথায় আক্রান্ত ব্যক্তি মারাত্মক হতে পারে। সে হিসেবে এখন দুই ধরনের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ চলছে। এদের মধ্যে এক গ্রুপ সাধারণ ছুটির পর বাড়িতে গেছেন ২৫ মার্চ। গড়ে ২০ দিন ধরলে এরা ইতিমধ্যেই আক্রান্ত।

দ্বিতীয়ত, পরবর্তী গ্রুপ ৪ এপ্রিল ঢাকায় ফিরলেন। এখন এদের সংক্রমণের পালা চলছে। এটা চলবে এ মাসের ২৩-২৪ তারিখ পর্যন্ত। এরপর এদের সান্নিধ্য যারা এসেছেন তাদের ইনকিউবেশন পিরিয়ড চলবে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। অর্থাৎ সে হিসেবে মে মাসের শেষদিকে সংক্রমণ সর্বোচ্চ হতে পারে।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, এখন যে ট্রেন্ড, সেটা বাড়তির দিকে। সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়ছে। পিক বা চূড়ায় পৌঁছানো বলতে বোঝায় যে,ক্রমাগত সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার যে পর্যায় সেটি চলতে থাকবে এবং এক পর্যায়ে গিয়ে এই হার সর্বোচ্চ হবে। আর তার পরই সংক্রমণের হার নেমে আসবে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে বেশি বাড়তে পারে।

অন্যান্য দেশের সর্বোচ্চ সংক্রমণের ট্রেন্ডকেও আমলে নিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, চীন বাদে বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রম সংক্রমণের পর ৩৮ থেকে ৭৬ দিনের মাথায় এক দিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্ত হতে দেখা গেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ৭৬ দিনের মাথায় এক দিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত পাওয়া যায় ৩২,১০৫ জন। যুক্তরাজ্য ৬৭তম দিনে, ফ্রান্স ৬৬, জার্মানি ও স্পেনে ৬১, ইতালি ৫৩, ইরানে ৪২ এবং নেদারল্যান্ডসে ৩৮তম দিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ধরা পড়ে। সে হিসেবে এবং দেশের ভেতর সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ হতে পারে।

তবে ঠিক কবে নাগাদ সংক্রমণ সর্বোচ্চ হতে পারে তা বুঝতে আরও অন্তত সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করতে বললেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, পিকটা নির্ভর করে রোগটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া কর্মসূচির ওপর। মোট রোগীর ৮০ শতাংশই ঢাকা শহরে ও ঢাকা বিভাগে। আমরা যদি সংক্রমণ কমাতে চাই তা হলে এই দুই জায়গায় নজর দিতে হবে সবচেয়ে বেশি।

পাশাপাশি যদি অন্যান্য জেলাসহ টোটাল ইন্টারভেনশন মাথায় না রাখি, তাহলে রোগটি বাড়বে। মৃত্যুও বাড়বে। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ চূড়ায় যেতে সময় বেশি লাগবে। এখন আমাদের সামনে দুটি লক্ষ্য এক. ঢাকা শহরে ও ঢাকা বিভাগে শক্তভাবে কাজ করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব রক্ষা ও লকডাউনের পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে হবে। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ভালো করতে হবে। এখানে আমরা এখনো খুবই দুর্বল। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ইন্টারভেনশন প্রোগ্রাম স্ট্যান্ডার্ড মেথড অনুযায়ী চললে পিক বের করা যাবে।

সামাজিক দূরত্ব রক্ষা ও লকডাউন মানার ক্ষেত্রে কিছুটা উনড়বতি হচ্ছে। তবে চিকিৎসা ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। পিকটাইম বের করতে এখনো সাত দিন লাগবে। কারণ এখনো একেক দিন একেক ট্রেন্ডে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে। এখনো বোঝা যাচ্ছে না। এখনো প্রিভেনশন স্ট্যান্ডার্ড হয়নি। চিকিৎসা তো শুরুই হয়নি।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বর্তমান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আমরা প্রমথদিকে ঠেকাতে না পারলে পিক টাইমে যেতে সময় লাগবে। কমতেও সময় লাগবে। এখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় শহরগুলো। শহরের চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। মহামারী ঠেকানোর মতো জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা শহরাঞ্চলে নেই বললেই চলে। কোনো কাঠামোই নেই। এটা ঠিক করতে হবে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাসেবক বাড়াতে হবে। লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতেই হবে।