দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে দেশের সরকারী ছুটির সঙ্গে সঙ্গতি রেখের পুঁজিবাজারও বন্ধ রয়েছে প্রায় ১ মাস ধরে। এছাড়া সরকারী ছুটি ও পুঁজিবাজার বন্ধের মেয়াদ বাড়বে কি বাড়বে না এ নিয়ে চলছে নানা মতবিরোধ। ডিএসই একটি পক্ষ লেনদেন চালু করা কথা বললেও অন্যপক্ষটি লেনদেন চালু নিয়ে মতবিরোধ করছে। এ অবস্থায় লেনদেন আসলে কি চালু হবে নাকি সরকারী বন্ধের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বন্ধ থাকবে নিয়ে বিনিয়োগকারীরা রয়েছেন ধেয়াঁশার মধ্যে।

এছাড়া এই পরিস্থিতিতে বিশেষ করে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। লেনদেনের ওপর তাদের আয় নির্ভর করায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি রয়েছে। এদিকে করোনার প্রভাবে পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আয় রোজগার বন্ধ রয়েছে। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। অধিকাংশ পরিবারে দু’মুঠো খেতে হিমমিশ খাচ্ছেন।

না পারছেন কাউকে লজ্জায় বলতে না পারছেন কারো নিকট হাত পাততে। এ অবস্থায় মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে যাদের আয়ের পুরোটাই পুঁজিবাজার নির্ভর। পুঁজিবাজার বন্ধ থাকায় তাদের আয় রোজগার বন্ধ রয়েছে। অনেকেই অর্থ কষ্টে পড়েছেন। করোনার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হলে তারা আরও সংকটে পড়বেন। এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রনোদনার দাবি জানিয়েছেন তারা।।

এছাড়া বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশ যারা নিয়মিতভাবে বাজারের ওপর নির্ভরশীল তারা লেনদেন চালু না হওয়ায় প্রয়োজনেও শেয়ার বিক্রি করে টাকা উত্তোলন করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার চালু করার পক্ষে অনেকে। যা নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীরা চাইলেও চলমান মহামারীর কারণে সরকারী ছুটির মধ্যে লেনদেন শুরু করা সম্ভব না। কারণ বহির্বিশ্বের মতো অটোমেটিক সিস্টেম এখনও বাংলাদেশে চালু করা সম্ভব হয়নি।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, পুঁজিবাজারের সঙ্গে জড়িত সবাই লেনদেন চালু করার পক্ষে। তবে বাস্তবতার ভিত্তিতে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। কারণ লেনদেন চালু করতে গেলেই জনবল ও বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি প্রয়োজন পড়বে। যা চলমান মহামারীর মধ্যে জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লেনদেন চালু করা সম্ভব হবে না। এছাড়া অনেকে চাইলেও ছুটিতে গ্রামে চলে যাওয়ায় উপস্থিত হতে পারবে না। তাই সরকারী ছুটির মধ্যে লেনদেন চালু করা সম্ভব না বলে তারা মনে করেন।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেছেন, অর্থনীতির অন্যতম খাত পুঁজিবাজারও করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সংকটে পড়েছে। এতে বিপুল ক্ষতির শিকার হবে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীসহ বাজার সংশ্লিষ্ট সবাই। দীর্ঘ সময় শেয়ারবাজার বন্ধ রাখার দরকার নেই। সীমিত হলেও বাজার চালু করা উচিত। বন্ধ থাকলে ক্ষতি আরও বেশি হবে। তবে এই ক্ষতি পোষাতে শেয়ারবাজারকেও প্রণোদনার মধ্যে আনা উচিত। শেয়ারবাজার সরাসরি প্রণোদনা দেওয়ার দরকার নেই। প্রক্রিয়াগত প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফ, কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো, কনজামশন ট্যাক্স কমানো উচিত।

আবু আহমেদ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই সংকট মুহূর্ত পার করছি আমরা। কিন্তু আতঙ্ক বেশি ছড়াচ্ছে। এত আতঙ্ক ছড়ানো অনুচিত। ব্যাংক যেহেতু সীমিত আকারে খোলা আছে। শেয়ারবাজারও সীমিতভাবে খোলা রাখা উচিত। শুধু ফিলিপাইন স্টক মার্কেট বন্ধ রেখেছে। বাকি সব দেশেই এটা খোলা। এখন স্টক মার্কেট তো হাউসে গিয়ে লেনদেন করতে হয় না। বেশি দিন বন্ধ রাখলে ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে।

তিনি বলেন, সব দেশে মুদ্রানীতির মাধ্যমে শেয়ারবাজারকে সাপোর্ট দেয়। আমাদের এখানে সেটা খুব কম দেখা যায়। এখন যে পরিস্থিতি তাতে কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। নইলে বাজারে বড় সংকট হবে। দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে দিতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সানাউল হক  বলেন, ‘পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে পুঁজিবাজার চালু রাখার জন্য আইটি, সার্ভিল্যান্স, মনিটরিং, মার্কেট অপারেশনস ও ক্লিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট সীমিত পরিসরে কীভাবে খোলা রাখা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করছি। এরইমধ্যে আমরা বিষয়টি নিয়ে পরিচালনা পর্ষদে আলোচনা করছি। এমন পরিস্থিতিতে মার্কেট চালু করতে গেলে স্টক এক্সচেঞ্জের কিছু বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলেই মার্কেট চলু করা সম্ভব হবে।’

তবে এর মাঝেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মোঃ রকিবুর রহমান দেশের পুঁজিবাজারের লেনদেন চালু করার আহ্বান জানিয়েছেন। রবিবার এক বিবৃতিতে তিনি স্টক এক্সচেঞ্জ খুলে দিয়ে লেনদেন চালু করার আহ্বান জানান। এ বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।

তিনি বলেছেন, করোনার কারণে সাধারণ ছুটির মেয়াদ আবার বাড়লেও পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ রাখা যুক্তিসঙ্গত হবে না। করোনাভাইরাসে বিশ্বের অনেক দেশে লকডাউন থাকলেও কোন দেশেই পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ করা হয়নি বিধায় বিশ্বায়ন ব্যবস্থায় বাংলাদেশ অন্য দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না বলে রকিবুর রহমান জানান।

রকিবুর রহমান বলেন, যেহেতু বিএসইসি শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস (শেয়ারের দামের সর্বনিম্ন সীমা) বেঁধে দিয়েছে, তাই বাজারে দর পতনেরও কোন ভয় নেই। বরং বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ২শ’ কোটি টাকা করে যে তহবিল সুবিধা দিয়েছে, তা এই সময়ে বিনিয়োগে এসে বাজারকে সাপোর্ট দিতে পারে। মানবিক কারণে হলেও পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু করা জরুরী বলে তিনি মত দেন।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, লেনদেন চালু করা দরকার হলেও সেই সক্ষমতা আছে বলে মনে হয় না। কারণ লেনদেন চালু করতে মেইন কম্পিউটারটা (ম্যাচিং কম্পিউটার) পরিচালনা করতেই ২০-২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী দরকার পড়ে। যাদের সশরীরে উপস্থিত হতে হয়। এছাড়া লেনদেন কার্যক্রম চালাতে প্রতিটি ব্রোকারেজ হাউসে লোকবলের দরকার।

কিন্তু সরকারী ছুটির কারণে অনেকেই গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। তারা চলমান পরিস্থিতিতে হাউসে উপস্থিত হবে কি করে। এই পরিস্থিতিতে লেনদেন চালু করার ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।

ডিএসইর আরেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, শেয়ারবাজার বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি মানসিক যন্ত্রণায় আছে ব্রোকাররা। আমরা চাই বাজারটি খুলে যাক। এছাড়া খোলার অপেক্ষায় আছি। কিন্তু করোনাভাইরাসের বাস্তবতায় সরকার গত ২৬ মার্চ থেকে কয়েক ধাপে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারী ছুটি ঘোষণা করেছে। তবে অন্যান্য দেশে রাষ্ট্রীয় ছুটির পরিবর্তে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অন্য সব দেশের শেয়ারবাজার চালু রাখা সম্ভব হলেও আমাদের দেশে সম্ভব না। কারণ সরকারী ছুটির সঙ্গে সঙ্গে আইনগতভাবে কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। এর আওতায় বিএসইসি, সিডিবিএল ও স্টক এক্সচেঞ্জও রয়েছে।

তিনি বলেন, অন্যান্য দেশের শেয়ারবাজারের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু পার্থক্য রয়েছে। অন্যান্য দেশে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান একক সত্তা হলেও আমাদের এখানে ভিন্ন। বাংলাদেশে বিএসইসির ওপর আইনী বিষয়গুলো এবং সিডিবিএলের ওপর লেনদেন নিষ্পত্তির বিষয় নির্ভর করে।

ফলে এ দুটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শেয়ারবাজার খোলা রাখা সম্ভব না। এছাড়া ছুটির মধ্যে ব্যাংকের লেনদেন সময় সীমিত করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে স্টক এক্সচেঞ্জের দৈনিক ৩০০-৪০০ কোটি টাকার লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব না।

ডিএসইর লেনদেন অটোমেটেড হলেও আন্তর্জাতিক মানের হয়নি বলে দেশ প্রতিক্ষণকে জানান মিনহাজ মান্নান ইমন। তবে চায়নার কারিগরি সহযোগিতায় সেই লক্ষ্যে অচিরেই পৌঁছে যাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, মোবাইল এ্যাপসটি চালু করা হলেও সেভাবে ব্যবহার হয় না। অথচ চায়নায় শেনজেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জে ৯৫ শতাংশ লেনদেনই মোবাইলে হয়। তবে আমাদের দেশেও হবে, একটু সময় লাগবে।

এছাড়া এখনও ব্যাংকে চেক দেয়া-নেয়া করে টাকা জমা ও উত্তোলন করতে হয়। ফলে এই মুহূর্তে ঘরে বসে লেনদেন করা সম্ভব না। তিনি বলেন, দেশের অংসখ্য ভবনকে লকডাউনের আওতায় ফেলা হয়েছে। এই তালিকায় অনেক ব্রোকারেজ হাউসও পড়েছে। এছাড়া লক্ষ্যাধিক বিনিয়োগকারী লকডাউনের আওতায় রয়েছে।

এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের আপামর কোটি জনতার ন্যায় বিনিয়োগকারী, বিএসইসি, স্টক এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবনের মূল্য আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আগে জীবন, পরে ব্যবসা। তবে সরকারী ছুটি শেষে শেয়ারবাজার চালু করতে এক মুহূর্তও দেরি করতে চাই না।