দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে করোনার সংক্রমণ কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই জেলা দুটিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের ৪৬তম দিনে এসে করোনার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে ঢাকা শহর ও পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জ। এ পর্যন্ত দেশে মোট আক্রান্তের ৮৪ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগে। এর মধ্যে রাজধানীতে আক্রান্ত মোট রোগীর ৪১ দশমিক ২০ শতাংশ ও নারায়ণগঞ্জে ২৪ শতাংশ।

এমনকি ঢাকা শহর ও নারায়ণগঞ্জে মৃত্যুর সংখ্যাও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। গতকাল পর্যন্ত শুধু ঢাকা শহরেই করোনায় মারা গেছেন মোট ৬০ জন ও নারায়ণগঞ্জে ৩৬ জন। অর্থাৎ গতকাল বুধবার পর্যন্ত সারা দেশে যে ১২০ জনের মৃত্যু হয়েছে, এর মধ্যে ৯৬ জনই রাজধানী ও নারায়ণগঞ্জের। শতকরা হিসেবে এ সংখ্যা মোট মৃত্যুর ৮৪ শতাংশ।

এ দুই জায়গা থেকে রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন স্থানেও। গতকাল পর্যন্ত ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৮ জেলায় রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ২৯ জেলায় সংক্রমণ ঘটেছে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে যাওয়া আক্রান্তদের মাধ্যমে। শুধু নারায়ণগঞ্জ থেকেই আক্রান্ত হয়েছে ২৩ জেলা ও ঢাকা থেকে ৬ জেলা। বিশেষ করে ঢাকা বিভাগের যে ১৩ জেলায় করোনা দেখা দিয়েছে, এর বেশিরভাগই সংক্রমণ ছড়িয়েছে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে। এমনকি গত ২৪ ঘণ্টায় যে ১০ জন মারা গেছেন, তাদের মধ্যে সাতজন ঢাকার ভেতরে এবং ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে একজন করে।

এ দুই জেলায় কেন করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না জানতে চাইলে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আলমগীর হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব জায়গায় জনবসতি বেশি। জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। লোকজন লকডাউন মানতে চান না। সামাজিক দূরত্বও মানছেন না। সুতরাং একজনের থেকে রোগটি অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। তা ছাড়া এখানকার লোকজন লকডাউনের মধ্যেও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছেন।

এই বিশেষজ্ঞ ঢাকার ব্যাপারে বলেন, ঢাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাসাবো ও টোলারবাগে। এ দুই জায়গা থেকেই মূলত করোনা অন্যত্র ছড়িয়েছে। এ দুই জায়গায় সংক্রমণ হয়েছে মসজিদ থেকে। একসঙ্গে অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের শনাক্ত করা যায়নি।

নারায়ণগঞ্জের ব্যাপারে তিনি বলেন, এখানে সংক্রমণ থামানো যাচ্ছে না এ রকম নয়। এখানেই প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। ইতালি থেকে একদল লোক এসে এখানে ছড়ান। এমনকি কোয়ারেন্টাইন করে এসেও এখানে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তরা আবার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। এখানে ঘনবসতি। লোকজন কিছুই মানতে চান না।

এ দুই জেলায় করোনা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এখানে খুব কঠিনভাবে লকডাউন মানতে হবে। সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে হবে। যত কম মানুষ বের হবে, সংক্রমণ ততই কম হবে। পরীক্ষা বাড়ানোর চেয়ে এ দুই জয়গায় এখন চিকিৎসা দরকার। যারাই উপসর্গ নিয়ে আসবেন, তাদেরই কভিড-১৯ রোগী ধরে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হবে। সাধারণ মহামারীর সময় পরীক্ষার চেয়ে বেশি দরকার ব্যাপক হারে চিকিৎসা। সেটা না হলে সংক্রমণ ঠেকানো কঠিন হবে।

বেশি সংক্রমণ ও মৃত্যু ঢাকা শহরে : গতকাল পর্যন্ত ঢাকা শহরে দেশের সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছেন। সারা দেশে মোট রোগী যেখানে ৩৭৭২ জন, সেখানে ঢাকা শহরেই আক্রান্ত হয়েছেন ১২২৯ জন, মোট রোগীর ৪১ দশমিক ২০ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্য বিভাগের চেয়েও ঢাকা বিভাগের রোগী বেশি। সাত বিভাগে যেখানে মোট রোগী ৪৭৩ জন, সেখানে ঢাকা বিভাগে ১২৮১ জন। এই সংখ্যা দেশের মোট রোগীর ৪২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এ ছাড়া গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ঢাকা শহরের ১৪১ এলাকায় রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে।

এমনকি ঢাকা শহরে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে যেখানে মোট মারা গেছেন ১২০ জন, সেখানে ঢাকাতেই মারা গেছেন ৬০ জন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া সাতজন রয়েছেন। এর মধ্যে শুধু পুরান ঢাকাতেই ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়। এই রোগে দেশে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ১৮ মার্চ। প্রথম মারা যাওয়া ব্যক্তিও রাজধানীর বাসিন্দা ছিলেন। আইইডিসিআরের আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

ঢাকার এমন পরিস্থিতি কেন জানতে চাইলে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। বস্তিতেও অনেক মানুষ বাস করেন। বেশ কয়েকটি ক্লাস্টার (একটি জায়গায় কম দূরত্বের মধ্যে অনেক রোগী) পাওয়া গেছে। এসব ক্লাস্টার থেকে কমিউনিটি সংক্রমণটা (জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপকভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া) বেশি হয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রোগী রাজধানীতে এসেছেন। যে কারণে রাজধানীতে সংক্রমণ বেশি হওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি।

এ ব্যাপারে ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন ডা. মইনুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন এখানে জনসংখ্যা বেশি, লকডাউনও ঠিকমতো মানছেন না। লোকজন বের হন। সরকারের পক্ষেও কঠোর হওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া যেসব বিদেশফেরতের মাধ্যমে রোগটি দেশে ছড়িয়েছে, তাদের সবাই ঢাকায় ছিলেন। তারা ঘুরে বেড়িয়েছেন। কেনাকাটা করতে ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

তাদের মাধ্যমে অন্যরা আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে রোগটি কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন নিয়ন্ত্রণ করতে হলে লোকজনকে অবশ্যই ঘরে থাকতে হবে। ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। এখানে পরীক্ষা কম হচ্ছে না। কিন্তু নিয়মকানুন মানছেন না মানুষ।

কেন নারায়ণগঞ্জে সংক্রমণ বেশি : গতকাল পর্যন্ত ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলায় যে ১২৮১ জন রোগী পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ৫০৮ জনই নারায়ণগঞ্জের। এ সংখ্যা অন্য সাত বিভাগের মোট রোগীর চেয়ে ৩৫ জন বেশি। এ জেলায় করোনা শনাক্তে গতকাল পর্যন্ত মোট নমুনা সংগ্রহ হয়েছে ১৪০৬ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় এখানে মারা গেছেন একজন। আক্রান্ত হয়েছেন ৭৮ জন ও নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ২০৩টি। এই জেলায় মোট মারা গেছেন ৩৬ জন।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য বুলেটিনে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে রাখা হয়েছে ১৫০ জনকে, এখন পর্যন্ত মোট আইসোলেশনের সংখ্যা ৯০০ জন। ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশন থেকে ছাড়া পেয়েছেন ১৫ জন, এখন পর্যন্ত ছাড়া পেয়েছেন ৫৯৪ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৩২৪০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৩২৭ জন। বর্তমানে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৭৮ হাজার ১১৯ জন, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৬ হাজার ৭৮ জন।

নারায়ণগঞ্জে করোনার সংক্রমণ এত বেশি কেন জানতে চাইলে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বেশ কিছু কারণ তুলে ধরেন। তাদের মতে, ঘনবসতি ও শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা, বিদেশফেরত বিশেষ করে ইতালিফেরত প্রবাসীদের অবস্থান পুরোপুরি চিহ্নিত করতে না পারা, করোনায় প্রথম মৃত নারীর লাশ কুর্মিটোলা থেকে প্যাকেটবন্দি করে দেওয়ার পর সেই প্যাকেট খুলে লাশের গোসল দেওয়া, আক্রান্ত ব্যক্তির অবাধ বিচরণ, ৪ এপ্রিল অসংখ্য গার্মেন্টস শ্রমিকের নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ, লকডাউনে বিলম্ব এবং প্রশাসনের উদাসীনতাই মূল কারণ।

আমাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, দেশে প্রথম দুই পুরুষ ও এক নারী করোনা শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। পুরুষ দুজন ইতালি প্রবাসী। স্বামীর সংস্পর্শে এসে ওই নারী সংক্রমিত হন। তারা তিনজনই নারায়ণগঞ্জ শহরের ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা টানবাজার এলাকায় আল জয়নাল প্লাজায় থাকতেন। যদিও পরবর্তীতে তারা সুস্থ হয়েছেন। প্রবাসী এই ব্যক্তি বিদেশ থেকে আসার পাঁচ দিন পর তার করোনা পজিটিভ দেখা দেয়।

এর মধ্যে তিনি তার আত্মীয়স্বজনসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে মিশেছেন। হোটেল-রেস্তোরাঁয় গেছেন। অর্থাৎ পজিটিভ ধরা পড়ার আগে তিনি গোটা শহরে বিভিন্নজনের মাঝে রোগটি ছড়িয়েছেন। কিন্তু কোথায় কোথায় এবং কার কার মধ্যে এটা ছড়িয়েছেন তা চিহ্নিত করা যায়নি। এ ছাড়া ৩০ এপ্রিল যে নারী মারা যান, তিনি অসুস্থ থাকা অবস্থায় জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এমনকি মৃত্যুর পর তার দাফনও করোনার নিষেধাজ্ঞা মেনে করা হয়নি।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, গার্মেন্টস খোলার ঘোষণার পর আবার বন্ধ করা হলে হাজার হাজার শ্রমিক নারায়ণগঞ্জ চলে আসেন। পরে তারা আবার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া ৬ হাজার ২১ জন প্রবাসী জেলায় ফিরলেও জেলা প্রশাসন মাত্র ১ হাজার ২৫৯ জনের নাম ঠিকানা ও অবস্থান চিহ্নিত করতে পেরেছে এবং তাদের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করে। অন্যদের শনাক্ত করা যায়নি। এখন লোকজন লকডাউন মানছেন না। কোয়ারেন্টাইনও ঠিকমতো হচ্ছে না। এ সবই সংক্রমণের মূল কারণ।

এ ব্যাপারে জেলা সিভিল সার্জন ডা. ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, সংক্রমণ ঠেকাতে হলে লকডাউন ও পরীক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। জায়গা ছোট কিন্তু মানুষ বেশি। রোগটি বেশি ছড়াচ্ছে। এখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ সম্ভব নয়। নির্দিষ্টভাবে পরীক্ষার ল্যাবরেটরি করতে হবে। লকডাউনের মধ্যেও লোকজন যাচ্ছেন আসছেন। আজও (গতকাল) একটা পরিবার করোনা পজিটিভ নিয়ে কিশোরগঞ্জে গেছে। আমার প্রশ্ন কীভাবে গেল? এগুলো ঠেকানো না গেলে সংক্রমণ কমানো যাবে না।

জেলা দুটি থেকে রোগ ছড়াচ্ছে : গতকাল পর্যন্ত যে ৫৮ জেলায় রোগটি ছড়িয়েছে, এর মধ্যে ২৯ জেলায় ছড়িয়েছে এ দুই জেলা থেকে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ থেকে লোকজন গিয়ে ২৩ জেলায় এবং রাজধানী থেকে গিয়ে কমপক্ষে ৬ জেলায় রোগটি ছড়িয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিনই অন্য জেলায় আক্রান্তের কারণ হিসেবে এ দুই জেলা থেকে লোকজন যাওয়াকেই দায়ী করছে।

আইইডিসিআরের তথ্যমতে, গতকাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ থেকে যাওয়া ব্যক্তিরা ২৩ জেলায় রোগটি ছড়িয়েছেন। জেলাগুলো হলো টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, হবিগঞ্জ, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, চাঁদপুর, পিরোজপুর, ফরিদপুর, পাবনা, নরসিংদী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বান্দরবান, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, নড়াইল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, নওগাঁ, রাজশাহী, জয়পুরহাট, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর। এ ছাড়া পঞ্চগড়, জামালপুর, লক্ষ্মীপুর, কুড়িগ্রাম, বগুড়া ও ফেনীতে ঢাকা থেকে যাওয়া লোকজনের মাধ্যমে ছড়িয়েছে।