পীর হাবিবুর রহমান: শেয়ারবাজারে কি আর কখনো অস্তমিত সূর্য উদিত হবে? বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক খায়রুল হোসেনের এক দশকের অন্ধকার যুগের অবসান হলো। এই এক দশক ছিল ভয়ঙ্কর কারসাজি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাজার লুটপাটের কালো দশক। শেয়ারবাজারে সূর্য অস্ত গিয়ে অন্ধকার নামার দশক। খায়রুল যুগের অবসান ঘটিয়ে বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়েতুল ইসলাম। তিনি কি চ্যালেঞ্জ নিয়ে অস্তমিত সূর্য উদিত করতে পারবেন? এটা তার জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ।

কয়েক দিন আগে হঠাৎ করেই আমার ফেসবুক মেসেঞ্জারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমনের কথোপকথন হয়। আমার এত রাগ কেন এটা ছিল তার প্রশ্ন। এর দুই দিন পরেই দেখি তিনি আইসিটি মামলায় গ্রেফতার। মোজাম্মেল বাবুর এক অনুষ্ঠানে সজ্জন মানুষটি আমার সঙ্গে সস্ত্রীক পরিচিত হন। আমার লেখা ও টকশোর ভক্ত বলেন। মাঝেমধ্যে দেখা হয়েছে। কথা, কুশলবিনিময় হয়েছে।

সেদিন তিনি শেয়ারবাজারের বিপর্যয়ের জন্য বিএসইসিকে দায়ী করেন। আমি সেই সঙ্গে তাদের ব্যর্থতাও নিয়ে আসি। তিনি ঢাকা ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের মেরুদন্ডহীন অথর্ব নেতৃত্বের পক্ষে সাফাই গান। আমি তাকে বলেছিলাম শেয়ারবাজারে তিন গ্রুপ। এক গ্রুপ লুটে নেয়। আরেক গ্রুপ ভাগ পায়। শেষ গ্রুপ ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতোন তাকিয়ে দেখে আর সবার পেছনে হাঁটে। নেতৃত্ব কেবল ক্ষমতাবানদের সঙ্গে আমুদে ছবি তুলেই খুশি।

শেয়ারবাজার ও ব্যাংকি খাত একসঙ্গেই এই একদশকে লুটপাট হয়েছে ব্যাপক হারে। অর্থ পাচার হয়েছে বিদেশে। লুটেরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত সংসদে দাঁড়িয়ে কেবল অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। শেয়ার ও ব্যাংক লুটেরারা করোনাকালেও জনগণের পাশে নেই। এত্ত নিলর্জ্জ তারা।

শেয়ারবাজারে ’৯৬ সালের কেলেঙ্কারির পর বড় কেলেঙ্কারি হয় ২০১০ সালে। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী নিঃস্ব, পথে বসে যায়। আর লুটেরারা নিয়ে যায় ২০ হাজার কোটি টাকা। শেয়ারবাজারের আর্তনাদের মুখে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যান হয়ে আসেন ড. খায়রুল হোসেন। ২০১১ সালের ১৫ মে তিনি যোগদান করে তিন মাসে স্থিতিশীল করার অঙ্গীকার করলেও লুটেরাদের প্রশ্রয় দেন দুই হাত বাড়িয়ে। কারসাজি করে খারাপ কোম্পানির শেয়ার বাজারে এনে শেষ করার কলঙ্কজনক অধ্যায় গড়েন।

নিজেদের ভাগ্য বদল হলেও বিনিয়োগকারীরা তো শেষই, ব্রোকারেজ হাউসগুলোও রুগ্ন দশায় পতিত হয়। অনেকে বন্ধ, কর্মী ছাঁটাই করেন। সর্বশেষ পরিস্থিতিতে বাজার চাঙ্গা না হলে অনেকে দেউলিয়া হয়ে হাউস বন্ধ করবেন। অনেকের পাগল হওয়ার দশা। খায়রুল হোসেনের যুগ সর্বনাশের দশক হয়েছে শেয়ারবাজারে।

দেশের অর্থনীতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আইপিও বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক হলেও কমিশনের বিদায়ী চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ৯ বছরে সবচেয়ে কম অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় শেয়ারবাজারের আকারকে ক্রমান্বয়ে ছোট করে তুলছে। দেশের অর্থনীতির সঙ্গে শেয়ারবাজার এ সময় দাঁড়াতেই পারেনি, অগ্রসর হওয়া দূরে থাক। এ সময় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বাড়ানোর দরকার পড়লেও কমিয়েছে।

খায়রুল হোসেনের নয় বছরের দায়িত্বকালে ২০১৪ সালে বড় দরপতনের ঘটনা ঘটে। ২০১৫/১৬ সালে শেয়ারবাজারে কিছুটা উত্থান দেখা দিলেও স্থিতিশীলতা ছিল না। ২০১৯ শেষে এসে বাজার ভয়াবহ দরপতনের কবলে পড়ে। ২০১৯ সালের পতনেই বাজার থেকে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে যায়। ২০২০ সালের শুরু থেকেই বাজারে চরম অস্থিরতা তৈরি হয়।

চলতি বছরের তিন মাসের ব্যবধানে সর্বমোট প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা শেয়ারবাজার থেকে বের হয়ে গেছে। সর্বশেষ পরিস্থিতিতে দেখা যায়, গত নয় বছরের মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক চার হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছে। যা কোনোভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রকদের হাতে আছে বলে মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কারসাজি সিন্ডিকেট। বিনিয়োগকারীরা হয়েছেন নিঃস্ব। ২৬ মার্চ থেকে করোনাকালে শেয়ারবাজার বন্ধ হলেও আগেই এখানে নেমেছে নিস্তব্ধতা।

করোনায় বাংলাদেশে শেয়ারবাজার বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে বিশ্বের আর কোথাও শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ করা হয়নি। ইউরোপের চরম পরিস্থিতি মোকাবিলা করা ইতালি, স্পেনের শেয়ারবাজার একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। আমাদের পুঁজিবাজার আগেই টালমাটাল ছিল। করোনার ধাক্কায় ভয়াবহ পরিস্থিতি সামলাতে বন্ধ করে রাখতে হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বে আর কোনো দেশ অবশ্য লেনদেন বন্ধ করেনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারগুলোর সবচেয়ে বড় অংশীদার পাঁচশ কোম্পানির, যাদের এস অ্যান্ড পি ৫০০ বলা হয় তাদের দর ব্যাপক মাত্রায় পড়ে গেছে। ১৯৮৭ সালের পর এমন ধাক্কা আর খায়নি। বিশেষ করে প্রযুক্তিনির্ভর নাসদাক এক্সচেঞ্জে রেকর্ড পরিমাণ দরপতন হয়। ইউরোপের পুঁজিবাজারগুলো এখনো নিম্নমুখী। ইউরোপের অধিকাংশ কোম্পানি তাদের নিম্নমুখী ধারা দেখছে।

লন্ডন স্টক, জার্মানি, ফ্রান্স সব দেশের বাজারে দর হারিয়েছে অধিকাংশ কোম্পানি। এশিয়ার পুঁজিবাজারগুলোও খুব একটা ভালো করছে না। ভারতের তিনটি স্টকের সবই প্রতিদিন দর হারাচ্ছে। বিশেষ করে মুম্বাই স্টকের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এশিয়ার শক্তিশালী স্টক এক্সচেঞ্জ বলে পরিচিত সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক প্রায় তিন শতাংশের কাছাকাছি পতন হয়েছে। তবে তুলনামূলক হংকংয়ের শেয়ারবাজার কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশে প্রায় দেড় মাস ধরে বন্ধ রয়েছে শেয়ারবাজার লেনদেন। বাজারের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবাই চিন্তিত। যারা বিনিয়োগ করেছেন বন্ধ থাকায় এখন শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বের হয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। আগামীতে শেয়ারের আরও দর হারালে তাদের কী হবে তা নিয়ে সবাই চিন্তিত।

বাজার স্থিতিশীলতার জন্য সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পুনর্গঠন দরকার। বাজারে অর্থনৈতিক লেনদেন বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকগুলোর সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সহজশর্তে ঋণ দেওয়া উচিত। আইপিও বাড়াতে সরকারি কোম্পানিগুলো বাজারে তালিকাভুক্ত করা দরকার। এ ছাড়া বহুজাতিক কোম্পানিসহ বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো আইপিও হিসেবে আনতে হবে। কারসাজি সিন্ডিকেটে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি না হলে বাজার চাঙ্গা হবে না।  সুত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন