দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: রাজস্ব আহরণ বাড়াতে প্রতি বাজেটেই সিগারেটের ওপর সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাটের পরিমাণ বাড়ানো হয়। তামাক বিরোধী বিভিন্ন সংগঠনও এমন দাবি জানায়। গত পাঁচ বছরে সরকার গড়ে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট আরোপ করেছে সিগারেটের ওপর। এতে করে গড়ে পাঁচ বছরে সিগারেট থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বেড়েছে ১০৫ শতাংশ। তবে সরকারের রাজস্ব বাড়ার পাশাপাশি সিগারেটে মূল্য বাড়ায় কোম্পানির নিট মুনাফাও সমানতালে বেড়েছে। বিএটির গত পাঁচ বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালাচনায় এমন তথ্যই মিলেছে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালে বিএটি বাংলাদেশের রেভিনিউ থেকে সরকার সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বাবদ ১০ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল, যা ২০১৯ সালে ২১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এ সময়ে কোম্পানির নিট মুনাফা ৫৮৭ কোটি টাকা থেকে ৯২৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। পাঁচ বছরে বিএটির নিট মুনাফা বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। অবশ্য ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে নিট মুনাফা কিছুটা কমে যাওয়ায় এ খাতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে। ২০১৮ সালে কোম্পানির নিট মুনাফা হয়েছিল ১ হাজার ১ কোটি টাকা।

যদিও সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাটের কারণে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গত দুই বছর ধরেই বিএটি বাংলাদেশের সিগারেট বিক্রির পরিমাণ কমছে। কোম্পানিটির নিরীক্ষিত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৭ সালে বিএটি বাংলাদেশ দেশে ৫ হাজার ৩২০ কোটি স্টিক সিগারেট বিক্রি করে।

২০১৮ সালে বিক্রি কিছুটা কমে ৫ হাজার ১৪২ কোটি ৫০ লাখ স্টিকে নেমে আসে। আর ২০১৯ সালে সিগারেটের দাম আরও বাড়ায় বিক্রি নেমে আসে ৫ হাজার ৭৪ কোটি ৪০ লাখ স্টিকে। তবে সিগারেট বিক্রির পরিমাণ কমলেও কোম্পানির নিট বিক্রির পরিমাণ প্রতি বছরই বাড়তে দেখা গেছে। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সিগারেট বিক্রি প্রায় ৫ শতাংশ কমলেও নিট টার্নওভার বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ।

২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বিএটি এমডি শেহজাদ মুনিম জানান, সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জের আকারে ইতিমধ্যেই তামাক খাতে যথেষ্ট পরিমাণে কর চাপানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে তার খুচরা বিক্রি থেকে মোট আয়ের ৭৮ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বাবদ ব্যয় করতে হয়। প্রিমিয়াম সেগমেন্টের সিগারেটে মোট করহার দাঁড়ায় ৮১ শতাংশে, যা বিশে^র মধ্যে সর্বোচ্চ বলে দাবি করেন বিএটি বাংলাদেশের এমডি।

বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি মূল্য নির্ধারণ ও কর কৌশলের অনুপস্থিতির অভিযোগ জানিয়ে শেহজাদ মুনিম বলেন, এর ফলে নজিরবিহীনভাবে দাম বাড়ে। প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের সময় নির্দিষ্ট কিছু সেগমেন্টে করবৃদ্ধি করা হয়, যা শিল্পের স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলে। সরকারের রাজস্ব আদায়েও এর প্রভাব পড়ে। তাই দীর্ঘমেয়াদি তামাক কর আদায়ের মডেল থাকা গুরুত্বপূর্ণ, যা শিল্পের স্থায়িত্ব ও ধারাবাহিক আয় উভয়ই নিশ্চিত করবে।

এদিকে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কারখানায় তৈরি সিগারেট রপ্তানি করেছে বিএটি বাংলাদেশ। এতদিন কোম্পানিটি বিদেশে শুধুমাত্র তামাক পাতা রপ্তানি করে আসছিল। এবারই প্রথম দেশে কোম্পানিটির ১০৮ বছরের ইতিহাসে প্রথম তৈরি সিগারেট বিদেশে রপ্তানি করেছে। ২০১৯ সালে কোম্পানিটি ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগে চীন ও পূর্ব এশিয়ায় ৬ কোটি ৯০ লাখ পিস সিগারেট রপ্তানি করে, যার মূল্য ৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা। সিগারেট রপ্তানির প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া বেশ উৎসাহজনক।

তামাক পাতার চমৎকার মান ও অত্যাধুনিক উৎপাদন সুবিধার কারণে ২০২০ সালেও অন্যান্য সম্ভাব্য বাজারগুলোতে কারখানায় তৈরি সিগারেট রপ্তানির সুযোগ তৈরি করেছে। ২০১৯ সালে তামাক পাতাসহ সিগারেট রপ্তানির মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩৭৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ৭৩ শতাংশ বেশি।

বিএটি বাংলাদেশের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালে টার্নওভার হয়েছে ২৬ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। তবে আমদানিকৃত পণ্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। এ কারণে টার্নওভার বাড়লেও মোট আয় কমে গেছে। ২০১৯ সালে পরিচালন ব্যয়ও ২০ শতাংশ বেড়েছে। এ কারণে নিট মুনাফাও প্রায় ৮ শতাংশ কমে গেছে। ২০১৯ সালে বিএটি বাংলাদেশের নিট মুনাফা হয়েছে ৯২৪ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ১ হাজার ১ কোটি টাকা।

আমদানিকৃত পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়া ও স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে বলে বিএটি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। কোম্পানিটির উৎপাদন খরচে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় সিগারেটের ফিল্টার, কাগজ ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে। এসব আমদানি করতে ২০১৯ সালে কোম্পানিটির ২ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়।

কাঁচামাল অর্থাৎ তামাক পাতা বাবদ ২০১৮ সালে ৮২৪ কোটি টাকা ব্যয় করলেও ২০১৯ সালে তা ১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। উৎপাদন কাজে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মচারী বাবদ ৫৩৫ কোটি টাকা ব্যয় করে, যা আগের বছর ছিল ৫০৫ কোটি টাকা। এসব কারণে ২০১৯ সালে নিট মুনাফার হারও কমেছে। অন্যান্য বছরে নিট মুনাফার হার থাকে ৪ থেকে ৫ শতাংশে। আর ২০১৯ সালে তা ৩ শতাংশে নেমে এসেছে।

২০১৯ সালে বিএটি মোট ২২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকার কর দিয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি। বিএটির মোট রেভিনিউর ৮৪ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের কর বাবদ ব্যয়। সরকারের অভ্যন্তরীণ কর রাজস্বের ৮ শতাংশ আসে বিএটি থেকে।

কোম্পানিটি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানায়, মূল্যবৃদ্ধিতে ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার বিপরীতে গ্রাহকরা অবৈধভাবে আমদানি করা কম মূল্যের সিগারেটে ঝুঁকে পড়ে। লো-সেগমেন্টের সিগারেটের মূল্যবৃদ্ধি ও অবৈধভাবে আমদানি বাড়ায় সরকার ২০১৯ সালে অন্তত আড়াই থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে।