দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। এতে শিল্প, কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি অর্থনীতির চালিকাশক্তি ব্যাংক খাতও সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মুখে রয়েছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্যাকেজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়েছে ব্যাংকগুলোর ওপর।

এতে করোনাপরবর্তীতে অর্থনীতিকে সচল করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণ ও আদায় করতে হবে। এই সময় খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট, মুনাফা কমে যাওয়াসহ নানা ধরনের সংকটে পড়বে ব্যাংক খাত। এসব ঝুঁকি সক্ষমতার সঙ্গে মোকাবিলায় ১০টি প্রস্তাব দিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে ব্যাংক খাতে উচ্চপর্যায়ের ‘কভিড-১৯ ঝুঁকি মোকাবিলা কমিটি’ গঠন করার ওপরও জোর দিয়েছেন তারা।

গতকাল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত সেমিনারে এসব কথা বলেন গবেষক ও ব্যাংকাররা। ‘ইকোনমিক, মানিটারি অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর ইমপ্লিকেশনস অব কভিড-১৯ : প্রিপেয়ারডনেস অব ব্যাংকস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনলাইন সেমিনারের আয়োজন করা হয়।

সেমিনারে বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. মো. আখতারুজ্জামান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিস এ খান, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের এমডি মো. আলী হোসেন প্রধানিয়া, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ফারুক মঈনুদ্দিন, ইসলামী ব্যাংকের এমডি মাহবুব-উল-আলম, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের এমডি নাসের এজাজ বিজয় বক্তব্য দেন। গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের অধ্যাপক এবং পরিচালক (প্রশিক্ষণ) ড. শাহ মো. আহসান হাবীব।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক ও আর্থিক পুনরুদ্ধারে ব্যাংক খাতের সুসংগঠিত কার্যপ্রস্তুতি প্রয়োজন। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করোনা-সংক্রান্ত অর্থনৈতিক ও আর্থিক কার্যক্রমে ব্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহযোগিতার পাশাপাশি নিজস্ব ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায়ও মনোযোগ দিতে হবে। প্রতিবেদনে ১০টি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে অ্যাকশন প্ল্যান করার সুপারিশ করা হয়। ব্যাংক খাতের পুনরুদ্ধারে একটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।

প্রস্তাবনাগুলো হচ্ছে সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়গুলো চিহ্নিত করা, সম্ভাব্য অবকাঠামোগত পরিবর্তনে প্রস্তুতি নেওয়া, ঋণ ব্যবস্থাপনার ঝুঁকির দিকগুলোর পদ্ধতি সংস্কার আনা, বর্তমান ও সম্ভাব্য তারল্য ব্যবস্থাপনার দিকগুলো পর্যালোচনা করা, প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর সর্বোচ্চ সুষ্ঠু ব্যবহার, অর্থনীতিতে তারল্য বাড়াতে বিনিয়োগ পরিকল্পনা নেওয়া, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সব কাজে স্বচ্ছতা বজায় রাখা, প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির বিষয়ে দেখভাল করা, সব পর্যায়ে শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং আস্থা ও বিশ্বাস বাড়াতে কাজ করা।

বিআইবিএমের ডিজি আক্তারুজ্জামান বলেন, ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে হলেও এখনই তারল্য সংকট হবে না। তবে ভবিষ্যতে নানা সংকট হতে পারে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের একটি উচ্চপর্যায়ের কভিড-১৯ ঝুঁকি মোকাবিলার কমিটি করতে হবে। এ ছাড়া সরকারকেও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। লভ্যাংশ স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু এতে যেন ব্যাংকগুলোর কর দিতে না হয় সেজন্য এনবিআরের পদক্ষেপ প্রয়োজন। অর্থনীতিকে সচল করতে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

আনিস এ খান বলেন, আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। ভবিষ্যতে অনেক পরিবর্তন আসবে জীবন-যাপনে। বিশেষ করে অর্থ ব্যবস্থাপনায়। দেশের ব্যাংক খাতও একীভূত হতে পারে। এটিএম বুথ শেয়ারের মাধ্যমে সংখ্যা কমিয়ে আনা যেতে পারে। এতে ব্যয় কমে আসবে।

নাসের এজাজ বিজয় বলেন, ব্যাংকের সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার আমানতকারীদের দিকটি দেখতে হবে। তারা টিকে থাকলে ব্যাংক ঋণ দিতে পারবে। আমানত কমে গেলে ব্যাংক ঋণ দেবে কীভাবে। ব্যাংককে টিকে থাকতে হলে একটি পরিকল্পনা অবশ্যই থাকতে হবে। ব্যাংক খাতের সঙ্গে অর্থনীতির সব খাত জড়িয়ে পড়ছে। এজন্য ব্যাংক সমস্যায় পড়লে সব খাত সমস্যায় পড়বে।

তিনি বলেন, প্রণোদনার প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিয়ে আদায় করতে হবে। তাই সঠিক গ্রাহক নির্বাচন করে ঋণ প্রদান চ্যালেঞ্জিং। এতে খেলাপি ঋণের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

আলী হোসেন প্রধানিয়া বলেন, ঘোষিত প্রণোদনা বাস্তবায়নে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ২৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। এখন দেখা দরকার দেশের ব্যাংকগুলো এই অর্থ বিনিয়োগ করতে পারবে কি না।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, এক গবেষণায় উঠে এসেছে ৬৮ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের বাঁচাতে হবে। তাদের ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আসতে হবে। গত কয়েক বছর ধরে দেশের ব্যাংক খাত এমনিতেই ভালনারেবল অবস্থায় আছে। ৯ শতাংশ সুদ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যাংকের আয় কমে গেছে। তাই ব্যাংকের বিষয়গুলোও দেখতে হবে। সিএসআর বাস্তবায়নসহ ব্যাংকের আয়ে করহার পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।

ফারুক মঈনুদ্দিন বলেন, সব অফিস বন্ধ থাকলেও করোনাঝুঁকির মধ্যে ব্যাংক খোলা রাখা হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে এখন জরুরি সেবা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যাংকারদের মনোবল ধরে রাখতে হবে।