দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: করোনাভাইরাসের সংকটের কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকঋণের প্রতি আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে সরকার। চলতি অর্থবছরের ১৩ মে পর্যন্ত বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংকগুলো থেকে ৮১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭১ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে গত আড়াই মাসে ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ২৮ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। করোনা সংক্রমণের কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে কাক্সিক্ষত আয় না আসা ও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে সরকারের। আগামীতে আমদানি-রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আয়ের ঘাটতি আরও বাড়তে পারে। এর ফলে আগামীতে ব্যাংকঋণের ওপর সরকারের নির্ভরতা আরও বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের ১৩ মে পর্যন্ত ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর শেষ হতে এখনো প্রায় দেড় মাস বাকি। এরই মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার ৭১ শতাংশ বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার। চলতি অর্থবছরের ১৩ মে পর্যন্ত নেওয়া ৮১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেওয়া হয়েছে ৬৯ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১২ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, মূলত রাজস্ব আদায় কম হওয়ার কারণে সরকারের এই বিপুল অঙ্কের ঋণ গ্রহণ। তিনি বলেন, সরকারের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেওয়া কমানো উচিত। তাহলে ব্যাংকগুলো করোনা মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নে সক্ষম হবে। তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেওয়ার পরিবর্তে মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া উচিত সরকারের। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেবল ব্যাংকগুলোর তহবিলে নির্ভর না করে কঠোর রাজস্ব ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় জোর দেন সাবেক এ গভর্নর। এছাড়া করপোরেট কর কমানো ও কর নেট বাড়ানো উচিত বলে জানান।

দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ১-২ বছর সময় লাগবে, এমন পূর্বাভাস দিয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের উচিত বিদেশি সহায়তা ও বেসরকারি তহবিল ব্যবস্থাপনা সংস্থাগুলোর স্বল্প ব্যয়ের তহবিলের দিকে নজর দেওয়া। তাহলে স্থানীয় ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ কমবে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যাংকঋণ নেওয়ার বদলে সরকারের উচিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অব্যবহৃত অর্থ ব্যয় করা।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে প্রাথমিকভাবে ব্যাংক খাত থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার। পরে সংশোধন করে এ অঙ্ক বাড়িয়ে ৭২ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। ঋণ গ্রহণের সাম্প্রতিক চিত্রে দেখা গেছে, তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে প্রাথমিক লক্ষ্যের চেয়ে এরই মধ্যে ৩৩ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার। অর্থবছরের বাকি দেড় মাসে আরও ৮ হাজার ৪৭ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকায় আগামীতে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ আরও বাড়বে। চলতি অর্থবছর ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি থাকবে বলে মনে করছেন তিনি। বাজেটে প্রাথমিকভাবে ৩ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার। পরে তা সংশোধন করে কমিয়ে লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ কোটি টাকা করা হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে এনবিআর।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনা মহামারীই কেবল রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির কারণ নয়। এনবিআরের দক্ষতার অভাব ও সরকারের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যও অন্যতম কারণ। চলতি অর্থবছর এডিপি বাস্তবায়নেও ৮০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হতে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি। সরকার এডিপি বাস্তবায়নের লক্ষ্য কমিয়ে ১ লাখ ৯১ হাজার ৯২১ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে।

অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এডিপির ৪৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। যা ২০১৫ অর্থবছরের পর সর্বনিন্ম। ওই সময় এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ৫০ শতাংশের বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছর ব্যাংক খাত থেকে ১৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার। ২০১৭ ও ২০১৮ অর্থবছর ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া ঋণের বিপরীতে যথাক্রমে ১৮ হাজার ৪০৫ কোটি ও ২ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা পরিশোধ করেছিল সরকার।