দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শকাতর ও বিতর্কিত তথ্য সংবলিত কিছু অফিসিয়াল নথি এবং ফাইলে থাকা কতিপয় নোটশিট একটি দুষ্ট চক্র গায়েব করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগে প্রকাশ, ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের প্রথম কর্মদিবসেই সংস্থার বিতর্কিত ও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজস্ব ও প্রকৌশল বিভাগের দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেন।

আকস্মিকভাবে চাকরিচ্যুত হওয়ায় প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার (চলতি দায়িত্ব) অনিয়ম-দুর্নীতির অনেক কিছুই সরাতে বা সংশোধন করতে পারেননি। বিশেষ করে অবৈধ পন্থায় মার্কেটের দোকান বরাদ্দ দেয়া, বাজার সালামি গ্রহণ ও আত্মসাৎ, অবৈধ দোকানকে দুর্নীতির মাধ্যমে বৈধতা দেয়া, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে দোকান বরাদ্দ দেয়াসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ।

আরও পড়ুন…….

বরিশাল বিভাগে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান প্রস্তুত ৫৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক 

আর তাই প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (সিআরও) তার সিন্ডিকেটের সদস্য ও বিশ্বস্ত কয়েকজনকে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ বহন করে এমন নথি ও নোটশিট যত দ্রæত সম্ভব অফিস থেকে সরিয়ে ফেলার তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্রের দাবি। আর তার নির্দেশ মোতাবেক বাজার শাখা-২, বাজার শাখা-৩ ও অ ল-১ এর কতিপয় কর্মকর্তা গত রোববার রাতে এ জাতীয় নথি ও নোটশিট বাছাই করে রাখে।

পরবর্তিতে ওইসব বিভাগের উল্লেখিত কর্মকর্তারা গতকাল সোমবার সকাল ৮টায় অফিসে উপস্থিত হয়ে পূর্বের রাতে বাছাইকরা ফাইল ও নোটশিট তাদের সিন্ডিকেটের অন্যান্য বিশ্বস্ত সদস্য দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। বিশেষ করে চাকরিচ্যুত ওই রাজস্ব কর্মকর্তার প্রায় সকল অপকর্মের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ এবং খালাতো ভাই’খ্যাত বাজার শাখার এক কর্মকর্তা এসব কাজে অগ্রণী ভ‚মিকা রেখেছেন বলে অভিযোগে প্রকাশ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, চাকরিচ্যুত সিআরও এতদিন যাদেরকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন তারা এখন তাকে সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর এ লক্ষ্যে তার দুর্নীতির প্রমাণ থাকা সকল নথি ও নোটশিট অফিস থেকে সরাতে ব্যস্ত। এদের মধ্যে সিআরও-এর কথিত খালাতো ভাই’খ্যাত একজন উপ-কর কর্মকর্তা। সিআরও-এর বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ এ সহচরের মূল পদ উপ-কর কর্মকর্তা হলেও তাকে কর কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) এবং রাজস্ব কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) দেয়াসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছেন তিনি।

অথচ তার প্রায় দশ বছরের জ্যেষ্ঠ একাধিক কর কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংযুক্ত করে রেখেছেন সিআরও। এমনকি সম্প্রতি সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সিআরও তার ওই কথিত খালাতো ভাইকে উপ-প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি দেয়ার লক্ষ্যে ফাইল উপস্থাপন করলে সংস্থাপন শাখা থেকে তার ব্যাপারে একজন উপ-কর কর্মকর্তাকে দুটি পদ ডিঙ্গিয়ে কোনোভাবেই উপ-প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি দেয়া আইনসিদ্ধ হবে না মর্মে নোট দিলে ফাইলটি গায়েব হয়ে যায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। তবে বিষয়টি পুরো সিটি কর্পোরেশনে ওপেন সিক্রেট।

ডিএসসিসির একাধিক সূত্রের দাবি, ডিএসসিসি মেয়র গত রোববার যাদেরকে চাকরিচ্যুত করেছেন তা সংস্থাটিকে রক্ষায় যথার্থই হয়েছে। শুধু চাকরচি্যুত নয় এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়াসহ তাদের অর্থ-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে কর্পোরেশনের দেনা কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেয়া উচিত। ফাইল গায়েব করার বিষয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সচিব আকরামুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি শুনলাম, দেখি কি করা যায়।’

প্রসঙ্গত, সদ্য বিদায়ী মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের শেষ সময়ে এসে তড়িঘড়ি করে অনৈতিক পন্থায় ডিএসসিসিতে উপ-কর কর্মকর্তা (ডিটিও) পদে ৩১ জন ও কর কর্মকর্তা (টিও) পদে ৭ জনকে পদোন্নতি (অতিরিক্ত দায়িত্ব) দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল বিতর্কিত ওই সিআরও। প্রস্তাবিত ওই পদোন্নতিতে ডিএসসিসির চাকরি বিধি বা আইনের ন্যূনতম অনুসরণ করা হয়নি।

ডিএসসিসির জন্য সর্বশেষ প্রণীত তফসিল-২০১৯ অনুযায়ী ‘কোনো পদে কাউকে অতিরিক্ত বা চলতি দায়িত্ব প্রদান করতে হলে ওই পদের একধাপ নিচের কর্মকর্তাকে দায়িত্ব প্রদান করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওই পদের জন্য নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে।’ এ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ডিটিও পদের জন্য বিএ পাস নির্ধারিত থাকলেও এইচএসসি পাস লোকজনকে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের পাস কাটিয়ে সম্পূর্ণ অনৈতিক পন্থায় পদোন্নতি দেয়া হয়েছে তৃতীয় শ্রেণিদের।

আবার পদোন্নতির এ ফাইলে সিইও অনুমোদন দিয়ে স্বাক্ষর করেছেন ১ এপ্রিল এবং মেয়র ২ এপ্রিল। ও সচিব দফতরে এসেছে ২৮ এপ্রিল। পরবর্তিতে এ ফাইল সংস্থাপন শাখায় অফিস আদেশ জারির জন্য যায় ৪ মে। অনুমোদিত ওই ফাইলের স্মারক নম্বর- ৪৬.২০৭.০০০.১০.০১.০৮৮১.২০১৯ তারিখ ১৯.১২.২০১৯। ওই ফাইলে সংস্থাপন শাখা দ্রুত অফিস আদেশ জারি না করায় সহসচিব মো. আরশাদ হোসেনকে একটি মহল তখন চাপ সৃষ্টি করে এবং একপর্যায়ে ঘুষ প্রদানের প্রস্তাবও দেয়। অফিস আদেশ জারি না করতে পেরে একপর্যায়ে তাকেসহ সচিবের চেয়ার না থাকার হুমকিও দেন বলে জানা গেছে।

এছাড়া উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মার্কেটের কার পার্কিং-এর স্থানে ডিএসসিসির দোকান বরাদ্দ, ভাড়া পরিশোধ ও ট্রেড লাইসেন্স দেয়ারও অগ্রণী ভ‚মিকায় ছিল এই সিআরও। জানা গেছে, গুলিস্তান পুরান বাজার হকার্স মার্কেটের বেইজমেন্টে (কার পার্কিংয়ের নির্ধারিত স্থানে) দোকান নির্মাণ স্থগিতের আদেশ চেয়ে পুরান বাজার হকার্স মার্কেট সমিতির সদস্য মো. জাহাঙ্গীর আলম খোকন মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেন। রিট মামলা নং ৫৮৭১/২০১০।

মামলায় আদালত কার পার্কিংয়ের নির্ধারিত স্থানে দোকান নির্মাণের উপর ২০১০ সালের ২৫ জুলাই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ প্রদান করেন। হাইকোর্টের দেয়া আদেশ ডিএসসিসি কর্তৃক মার্কেট কমিটির নেতারা ও সদস্যদের জানিয়ে নোটিশ দেয়। যা গুলিস্তান পুরান বাজার হকার্স মার্কেট সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মনোয়ার হোসেন (মনু) ২০১১ সালের ২৯ মার্চ গ্রহণ করেন। দোকান নির্মাণের উপর আদালতের দেয়া স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ জানতে পেরে পুরান বাজার হকার্স মার্কেট সমিতির সভাপতি আব্দুল হান্নান (নান্নু) ও অন্যরা বাদী হয়ে হাইকোর্টের দেয়া ওই আদেশের বিরুদ্ধে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে লিভ টু আপিল করেন।

আপিল নং ২৬৯৩/২০১২। শুনানি শেষে আদালত ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল এই আপিলটি খারিজ করে দেন। যার ফলে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল থাকে। কিন্তু হাইকোর্টের দেয়া এ রায়ের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ডিএসসিসি গুলিস্তান পুরান বাজার হকার্স মার্কেটের বেইজমেন্টে অস্থায়ী দোকান বরাদ্দ, ভাড়া পরিশোধ ও ট্রেড লাইসেন্স দেয়া অব্যাহত রাখে।

এমনকি মার্কেট বরাদ্দ কমিটির সুপারিশ ব্যতিরেকে অথবা তাদেরকে পাশ কাটিয়ে ডিএসসিসির গত ইং ২০/০৬/২০১৯ তারিখের বোর্ড সভায় বিভিন্ন মার্কেটের অস্থায়ী বরাদ্দ দোকানের ভাড়া পরিশোধ ও ট্রেড লাইসেন্স প্রদানের অনুমতি দেয়। যা এসআরও নং ৩১০-আইন/২০১৬, ইং ১০/১০/২০১৬ এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আর এর মাধ্যমে ডিএসসিসির অসাধু মহল কোটি কোটি টাকা অবৈধ আয় করেছে। শুধু উল্লেখিত এ দুটি বিষয়ই নয় বিভিন্ন মার্কেটের নকশাবহিভর্‚ত শত শত দোকানকে বৈধতা দেয়াসহ বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে এ মহলটি আয় করেছে কোটি কোটি টাকা।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকার দুই মেয়রের সাক্ষাৎ: ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নবনিযুক্ত দুই মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও মো. আতিকুল ইসলাম স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন।

গতকাল সোমবার সচিবালয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়রদ্বয় পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রীর সাথে এ সাক্ষাৎ করেন। মন্ত্রী এ সময় উত্তর সিটিতে আতিকুল ইসলাম এবং দক্ষিণ সিটিতে মেয়র হিসেবে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব গ্রহণ করায় ধন্যবাদ জানান এবং তাদের সফলতা ও কল্যাণ কামনা করেন।

তিনি এ সময় বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু মোকাবিলায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করার জন্য দুই মেয়রকে আহ্বান জানান। এ সময় তিনি বাসা-বাড়ি, সরকারি অফিস, বিভিন্ন ভবনের ছাদ ও টবে জমে থাকা পানি পরিষ্কারসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। এছাড়া দুই মেয়রকে সিটি কর্পোরেশনের সব ধরনের কাজে সহযোগিতার আশাবাদ ব্যক্ত করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী।সুত্র: মানবকন্ঠ