দেশ প্রতিক্ষণ, ভোলা: ভাই, আমরা ডুইব্বা যাইতাছি। আমরা ভাসতে আছি।’ বুধবার রাত ১২টার দিকে ফোন করে বলছিলেন মো. নাছিম (৩৪)। তাঁর বাড়ি ভোলার লালমোহন উপজেলার পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নের চর শাহজালাল গুচ্ছগ্রামে। এখানে ৭০টি পরিবারের আড়াই শতাধিক মানুষের বসবাস। জনবিচ্ছিন্ন, দুর্গম এ চরের চারপাশে তেঁতুলিয়া নদী।

চরের বাসিন্দারা জানালেন, তারা আম্পানের খবর জানেনই না। বুধবার দুপুরের জোয়ারে ঘর-বাড়ি ডুবে গেলে চেয়ারম্যানকে ফোন দিয়ে জানতে পারেন ঘূর্ণিঝড়ের খবর। কিন্তু ওই মুহূর্তে ঘর থেকে বের হওয়া সম্ভব ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে চরেই থেকে যেতে হয়।

চর শাহজালালের মানুষ যেমন ঘূর্ণিঝড় আম্পানের খবর জানেন না। তেমনি লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাবিবুল হাসান রুমীও চর শাহজালালের খবর জানেন না। তিনি জানান, লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনার জন্য তেঁতুলিয়া নদীতে তাঁদের পাঁচটি ট্রলার ছিল। কিন্তু চর শাহজালালের খবর কেউ তাদের জানায়নি।

চরের বাসিন্দা মো. নাছিম বলেন, দুপুরের জোয়ারের পানি নামতে না নামতে বিকেল পাঁচটার দিকে আবার জোয়ার আসে। এবারের জোয়ার আরও ভয়ংকর। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আস্তে আস্তে পানি বাড়তে থাকে। খাটের ওপর পানি উঠে যায়। রান্না ঘর ডুবে যায়। সঙ্গে বাতাস। যেন উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যখন ঘরে থাকা যাচ্ছিল না, তখন স্ত্রী-সন্তানদের একে একে চারটি জেলে নৌকায় উঠিয়ে দেন। সে নৌকা ভাসিয়ে নিয়ে বন-জঙ্গলের মধ্যে খালের মধ্যে নোঙর করে। সারা রাত তাঁদের সেখানে রাত কেটেছে।

এ রকম একটি নৌকায় ছিলেন পেয়ারা বেগম (৪৩)। তিনি বলেন, তাঁর আট ছেলে-মেয়ে। তাঁর স্বামীর নাম আবুল কাশেম মাঝি। ভাঙনের পরে এ চরে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের নৌকায় ৪০-৪৫ জন ছিল। গুচ্ছগ্রামের পেছনে যে জঙ্গলের মতো আছে, সেখানে এটা খাল আছে। সেই খালে তাদের নৌকা বাধা ছিল। প্রচণ্ড বাতাসে ছিঁড়ে যায়। পরে ভাসতে ভাসতে একটা ঝোপে আটকে যায়। সারা রাত ভয়ের মধ্যে ভাসতে ভাসতে রাত কেটেছে। বাচ্চারা চিৎকার চেঁচামেচি করেছে। কিন্তু বৃষ্টি ছিল না। যার কারণে সমস্যা হয়নি। রাত তিনটার দিকে জোয়ার কিছুটা নেমে গেলে ঘরে ফিরে আসেন।

আবুল কাশেম মাঝি বলেন, প্রায় ১৫০ জন লোক নৌকার মধ্যে গাদাগাদি করে রাত কাটিয়েছে। কেউ কেউ ঘরের পানির মধ্যে ছিলেন। চরের মানুষ সারা রাত নির্ঘুম ছিল। সকালের দিকে পানি নেমে গেছে। গুচ্ছগ্রামের প্রায় ৬০টি ঘরের ভিটে মাটি ভেসে গেছে। ঘরের টিন উড়িয়ে নিয়েছে। চুলা নেই। খেতের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। চরের পাঁচটি পুকুর ডুবে মাছ চলে গেছে। সব মিলিয়ে চরের ৭০টি ঘরের ক্ষতি হয়েছে।

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ ঘটনা সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, চর শাহজালালের মানুষদের দুপুরের দিকে নিরাপদ আশ্রয়ে আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা আসেনি। তিনি আরও বলেন, তাঁর ইউনিয়নের ফসল ও বাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ৩৫টি মাছের ঘের ডুবে গেছে। ২৫টি কাঁচা ঘর ধ্বংস হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬০-৮০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।