ডা. মহসীন আহমদ: করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। আমার ধারণা জুনের মাঝামাঝি বাংলাদেশে করোনা প্রকোপ নিম্নগামী হবে। এতদিনে কত প্রাণহানি হয় সেটাই দুশ্চিন্তার কারন। তাই দয়া করে সবাই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন। যেখানে এই বছর বাংলাদেশ থেকে কেউ হজে যেতে পারছেন না, ঈদ কিভাবে হবে একটু সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবে দেখুন। বেঁচে থাকলে অনেক ঈদ আমরা জাঁকজমকভাবে করতে পারব, ইনশাআল্লাহ।

সবসময় ভেবে নিন, আপনি অথবা আপনার পাশের লোকটি করোনা পজেটিভ। কারণ, ৫০-৬০ ভাগ করোনা পজেটিভদের উপসর্গ থাকছে না। এটা করোনা ছড়িয়ে পড়ার উল্লেখযোগ্য কারণ। তাই আপনি, আমি সবাই মাস্ক ব্যবহার করব। চিকিৎসক ছাড়া বাকিরা পাতলা সুতি কাপড়ের পরিষ্কার মাস্ক ব্যবহার করব। ৩টি মাস্ক বাসায় রাখুন। একটা ধুয়ে অন্যটা ব্যবহার করুন। বাসা থেকে শুরু করে সব জায়গায় ৬ ফুট দুরত্বে থাকার চেষ্টা করুন। কমপক্ষে ৩ ফুট তো অবশ্যই।

জরুরি প্রয়োজনে বাসার বাইরে গেলে মাস্ক পরে বের হবেন। গণপরিবহনে উঠবেন না, হাটার অভ্যাস করুন। প্রয়োজনে রিকশা অথবা সাইকেল ব্যবহার করুন। বাসার বাইরেও ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন। ৬০ বছর বয়সের বেশি অথবা যে কোনো বয়সের হার্ট, কিডনি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, এজমা ইত্যাদি রোগে যারা ভুগছেন তারা কোনোভাবেই বাসা থেকে বের হবেন না। বাসায় ফিরে সরাসরি বাথরুমে যান, কাপড় খুলে গোসল করে ঘরের অন্য সদস্যের রুমে প্রবেশ করুন।

আরও পড়ুন…….

১১ দিনেই রোগী সুস্থ, বিনামূল্যে ‘রেমডিভিসির’ দেবে বেক্সিমকো 

ধুমপান করবেন না। প্রচুর পানি, ফলমুল, শাকসবজি, ডিম খাবেন। ৭- ৮ ঘণ্টা ঘুমাবেন। পরিবারকে সময় দিন। আপনার নিজের ভিতরের সৃজনশীলতা খুঁজুন আর সেটাকে কাজে লাগিয়ে বাসায় সময় কাটান। রোগ প্রতিরোধ বাড়ায় কিছু ঔষধ খাওয়া যেতে পারে। যেমন- ভিটামিন সি (Tab Ceevit), ভিটামিন ডি (Cap D Rise 20000/40000 unit) সপ্তাহে ২টা করে ২ মাস, জিংক (Tab Xinc) ২টা করে ২ মাস, ভিটামিন এ (Cap Retinol Forte 50000 unit) ১টা করে পর পর ৪দিন।

আপনার ও পরিবারের কারো করোনা পজেটিভ হয়ে গেলে ঘাবড়াবেন না। ৫০-৬০ ভাগ রোগীর কোনো উপসর্গ থাকে না। ৩০-৪০ ভাগের অল্প ও মধ্যমমানের উপসর্গ থাকে। যেমন- জ্বর, কাশি, গলা ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, শরীর ব্যাথা, খাবারের অরুচি, নাকে গন্ধ না পাওয়া ইত্যাদি। এই পর্যায়ে আক্রান্ত রোগী নিজের বাড়িতে সম্পূর্ণ আইসোলনে থাকবেন। কোনোভাবেই বাড়ির অন্য সদস্যের সামনে আসবেন না।

খাওয়া-দাওয়া, বাথরুম ইত্যাদি সবকিছু আলাদাভাবে করবেন। যদি বাসায় কমন বাথরুম থাকে, সেটাকে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ধোয়ার পর অন্যরা ব্যবহার করবেন। রোগীসহ অন্যরাও মাস্ক ব্যবহার করবেন, এতে সংক্রমণের হার কমে যাবে। যেহেতু রোগী সবসময় একা থাকেন, তাই মানসিক শক্তি খুব জরুরি। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে সবাই তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন এবং তাকে সাহস দিবেন।

অল্প ও মধ্যম উপসর্গের ক্ষেত্রে তেমন কোনো চিকিৎসা কিছু নেই, শুধু উপসর্গ অনুযায়ী ঔষধ খেতে হবে। যেমন- জ্বর আর শরীর ব্যাথায় প্যারাসিটামল (Tab Napa), সর্দি-কাশিতে এন্টিহিস্টামিন (Tab Deslor), ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসকের পরামর্শমত Cap Doxicap 100 mg ২টা একসাথে, তারপর সকালে ও রাতে ১টা করে ৭ দিন খেতে হবে। Tab Ivermactin (Scabo 6 mg), ওজন ৬০ কেজির বেশি হলে ৩টা, আর কম হলে ২টা খাবেন।

তবে প্রতিটি ঔষধ চিকিৎসকের পরামর্শে খাবেন। যেমন যারা Tab Warfarin খান তারা Tab Ivermactin খাবেন না, কারণ রক্তক্ষরণ হতে পারে। চিকিৎসকদের চেম্বার আর হাসপাতালে একেবারে প্রয়োজন ছাড়া যাবেন না, টেলিমিডিসিনের মাধ্যমে পরামর্শ নিবেন।

করোনা পজেটিভ রোগী কখন হাসপাতালে যাবেন? আপনার বাসায় যদি Pulse oxymetry থাকে তাহলে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা জানা সহজ। যদি ৯০ এর নীচে নেমে যেতে থাকে দেরি না করে হাসপাতালে যাবেন। আর Pulse oxymetry না থাকলে যদি শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে, আপনার নিজস্ব স্বাভাবিক কাজ, যেমন- কথা বলতে, বাথরুমে যেতে কষ্ট হয়, তাহলে হাসপাতালে যোগাযোগ করবেন।

বিশেষ করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ধুমপায়ী, হার্ট, কিডনি রোগী হাসপাতালে যোগাযোগ করবেন। হাসপাতালে রুগীর চাপ বেড়ে গেছে, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো বাসায় অক্সিজেন দিতে পারেন। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শমত Inj Enoxaparine 40 mg নাভীর পাশে চামড়ার নীচে দেওয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য যে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়াতে Dengue test ও Platelet count দেখে নেয়া ভালো।

কিন্তু ৫-১০ ভাগ করোনা পজেটিভ রোগীর আসলেই ভাগ্য খুব খারাপ। কেউ কেউ অল্প ও মধ্যম উপসর্গ থেকে খুব খারাপ অবস্থায় চলে যেতে পারে। আবার কিছু রোগী হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে যেতে পারে। তাদেরকে অতি দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। Concentrated oxygen নিজেরা ব্যবস্থা করতে পারেন। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।

তবে যতটা সম্ভব ভেন্টিলেটর ছাড়াই চিকিৎসা করা উত্তম। সঠিক ফলোআপ, নিয়মিত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, Anti Viral drugs, Plasma therapy ব্যবস্থার সাথে সাথে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মানবিক ব্যবহার ও আল্লাহের কৃপায় রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন।

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন করোনার ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা। সব রোগীদের করোনা পজেটিভ ধরে নিয়ে নিজেদের (চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী) সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মানবিক আচরণ দিয়ে সবার চিকিৎসা করতে হবে। সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও জনগণকে এই ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বুঝতে হবে উনারাও মানুষ, তাদেরও পরিবার পরিজন আছে। তারা সবাই করোনা ঝুঁকি নিয়ে জনগণের সেবায় হাসপাতালে কর্মরত আছেন। তাদেরকে সন্মান করুন, নিজে বাঁচুন।

করোনা বায়ুবাহিত ছোঁয়াচে রোগ। তবে করোনা রোগী অচ্ছুৎ নয়, তাদেরকে অসম্মান করবেন না। মনে রাখবেন, আপনি-আমি সবাই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারি। অতএব করোনা রোগী ও তাদের পরিবারের সাথে মানবিক আচরণ করি। করোনা রোগী মারা গেলে তার সৎকারের ব্যবস্থা করি। ইতিহাসে মানুষের জয় হয়েছে সবসময়, আশা করি, এবারও করোনাকে জয় করবে মানবজাতি। ততদিন শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সাবধানে সব নিয়ম মেনে চলি।

ডা. মহসীন আহমদ, সহযোগী অধ্যাপক (ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি), জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল