দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: করোনাভাইরাসের কারণে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়াতে গত ১৯ মার্চ তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। শেয়ারের সর্বনিম্ন দর বেঁধে দিয়ে ফ্লোর প্রাইস আরোপের প্রধান কারণ ছিল দরপতন রোধ করা। এতে বড় ধরনের দরপতন রোধ করা গেলেও লেনদেনে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কমে গেছে।  পর্যাপ্ত ক্রেতা না থাকায় বেশির ভাগ সিকিউরিটিজের দর ফ্লোর প্রাইসে আটকে গিয়ে দর অপরিবর্তিত থাকছে। মূল বাজারের পরিবর্তে বিনিয়োগকারীরা চুক্তিভিত্তিক (ব্লক মার্কেট) লেনদেনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। পুঁজিবাজারের লেনদেন পর্যালোচনায় এমন তথ্য মিলেছে।

সর্বনিম্ন সীমা বেঁধে দেওয়ায় তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার দর অপরিবর্তিত থাকছে। বুধবার ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ৮১ শতাংশ শেয়ারের দর অপরিবর্তিত ছিল। সোমবারও ৭৮ শতাংশ শেয়ারের দর অপরিবর্তিত ছিল। অন্তত ৬০টি সিকিউরিটিজ লেনদেনই হয়নি। ফ্লোর প্রাইস আরোপের পর থেকেই ডিএসইতে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শেয়ারের দর অপরিবর্তিত থাকছে এবং প্রতিদিনই এর পরিমাণ বাড়ছে। গত ৩১ মে ১৯৫টি ও ১ জুন ২৩০টি শেয়ারের দর অপরিবর্তিত ছিল।

আরও পড়ুন…….

পুঁজিবাজারের প্রতি আগ্রহ নেই, ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন 

এদিকে আজ সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মূল্য সূচকের পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। আজ ডিএসইতে টাকার অংকে লেনদেনও তলানিতে নেমে গেছে। ১৩ বছরে এই বাজারে এত কম লেনদেন হয়নি আর। অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সূচকের মিশ্রাবস্থায় লেনদেন শেষ হয়েছে।

বৃহস্পতিবার ডিএসই প্রধান সূচক ১০ পয়েন্ট কমে ৩ হাজার ৯৫৩ পয়েন্টে এবং ডিএসই–৩০ সূচক ৭ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৩২১ পয়েন্টে নেমে যায়। এছাড়া ডিএসইএস বা শরীয়াহ সূচকও ৩ পয়েন্ট কমেছে। দিনভর লেনদেন হওয়া ৩০৯টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১১টির, দর কমেছে ৩৬টির এবং দর অপরিবর্তীত রয়েছে ২৬২টির।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে পুঁজিবাজারে বড় দরপতন রোধ করতে ১৯ মার্চ ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা হয়। এর আগের পাঁচ কার্যদিবসের শেয়ার দরকে গড় করে শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দেয় এসইসি। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কোনো সিকিউরিটিজের দর ফ্লোর প্রাইসের নিচে নামতে পারবে না। এভাবে ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেওয়ায় ১৯ মার্চ এক দিনেই কৃত্রিমভাবে ডিএসইর প্রধান সূচকটি ১০ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়।

এর ফলে সূচকটি এক দিনেই ৩৬০৩ পয়েন্ট থেকে ৩৯৭৪ পয়েন্টে উন্নীত করা হয়। পরবর্তী সময়ে সূচকটি ৪০৬০ পয়েন্টে উন্নীত হলেও গত তিন দিনের পতনে সূচকটি গতকাল ৩৯৬৩ পয়েন্টে নেমে আসে। সূচক কমাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে ব্যাংক খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ব্যাংকের লভ্যাংশ বেঁধে দেওয়া ও সেপ্টেম্বরের আগে লভ্যাংশ বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিধিনিষেধ আরোপ করায় খাতটির শেয়ারে বিক্রিচাপ বেড়েছে।

৩১ মে পুঁজিবাজারে লেনদেন চালুর পর থেকে ব্যাংক খাত দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি বাজার মূলধন হারিয়েছে। সূচকে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে খাতটির। ফলে ব্যাংকের শেয়ার দর কমায় তিন দিন ধরে সূচক কমছে। একই সময়ে স্কয়ার ফার্মা, গ্রামীণফোনসহ বড় মূলধনী কোম্পানির শেয়ার দরও কমছে।

এদিকে ফ্লোর প্রাইসের মাধ্যমে শেয়ারের সর্বনিম্ন সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও পুঁজিবাজারে লেনদেন তলানিতে নেমে এসেছে। ১৯ মার্চ ফ্লোর প্রাইস আরোপের পর থেকেই লেনদেন এক-তৃতীয়াংশে নেমে গেছে। আর এখন যে লেনদেন হচ্ছে, তার উল্লেখযোগ্য অংশই আসছে ব্লক মার্কেটে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ফ্লোর প্রাইস যে সময় আরোপ করা হয়, সেই সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গড় লেনদেন ছিল ৩১৪ কোটি টাকা।

আর পুঁজিবাজার বন্ধ হওয়ার সময় ২২২ কোটি টাকা। করোনায় ৬৬ দিন বন্ধ রাখার পর গত ৩১ মে পুঁজিবাজার চালু হলে গড় লেনদেন নেমে আসে ১৬২ কোটি টাকায়, যার বড় অংশই আসছে ব্লক মার্কেট থেকে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৯ মার্চ থেকে গতকাল পর্যন্ত ৯ কার্যদিবসে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এ সময়ে ব্লক মার্কেটে কেনাবেচা হয়েছে ৬৩২ কোটি ৮১ লাখ টাকার শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট। অর্থাৎ ফ্লোর প্রাইস আরোপের পর ডিএসইর মোট লেনদেনের প্রায় ৪০ শতাংশ আসছে ব্লক মার্কেট থেকে। গতকালও ডিএসইর মোট লেনদেনের প্রায় ৬৯ শতাংশ আসে ব্লক মার্কেট থেকে। ১৯ মার্চের পর বিদেশিরা ধারণ করেন এমন শেয়ারগুলো ব্লক মার্কেটে সবচেয়ে লেনদেন হয়েছে।

এর মধ্যে রেনেটা, স্কয়ার ফার্মা ও গ্রামীণফোন রয়েছে। তবে চুক্তিভিত্তিক লেনদেন সবচেয়ে বেশি হচ্ছে রেনেটার শেয়ারে। গত নয় কার্যদিবসে ব্লক মার্কেটে রেনেটার ৫১৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে, যা এ সময়ে ব্লক মার্কেটে লেনদেন হওয়া মোট টাকার ৮১ শতাংশ। আর এই শেয়ারের বেশির ভাগই কিনেছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)।

বাজারসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে এখন সবচেয়ে বেশি বিক্রিচাপ আসছে বিদেশিদের কাছ থেকে। স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এই বাজারের প্রতি বিদেশিদের আগ্রহ কমে গেছে। এ ছাড়া কিছু বিদেশি ফান্ড অবসায়নে যাওয়ায় শেয়ার বিক্রির চাপ রয়েছে। তবে ক্রেতা না থাকায় বিদেশিরাও শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না।

স্থানীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় না থাকায় এমন পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তহবিল গঠন করলেও এখন পর্যন্ত মাত্র দুটি ব্যাংক ওই তহবিল থেকে ঋণ নিয়েছে। ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের চেয়ে করোনাভাইরাসে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনা বাস্তবায়নে বেশি মনোযোগী বলে জানা গেছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিলের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে ব্যাংক খাতের।