দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: কোনো বিদেশী বিনিয়োগকারী তার নিট মূলধন দেশে ফিরিয়ে নিতে চাইলে আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে না। এমনকি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি না হলে তারাও মার্চেন্ট ব্যাংক বা কোনো চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট দ্বারা হিসাবায়ন করে নিট সম্পদ দেশে ফিরিয়ে নিতে পারবেন। স্থায়ী সম্পদের মূল্য অতিমূল্যায়িত করে বেশি অর্থ যেন কেউ দেশে নিয়ে যেতে না পারে সে জন্য আগে এসব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের প্রয়োজন হতো।

বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ নীতিমালায় এ বিষয়ে ছাড় দিয়ে সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সুযোগ দেয়ায় কোনো বিদেশী কোম্পানি শেয়ার অতিমূল্যায়িত করে বেশি অর্থ দেশে ফিরিয়ে নিলে যাচাই বাছাই করার সুযোগ থাকছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

রও পড়ুন…

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত বছর একটি বিদেশী কোম্পানি তাদের সমুদয় সম্পদ বিক্রি করে চলে যাওয়ার সময় ১০০ টাকার শেয়ারের বিপরীতে দাবি করেছিল ১ লাখ ৬ হাজার টাকা। তাদের জমির মূল্য ৫ গুণ বাড়িয়ে দেখিয়েছিল। নানা হিসাবের কারসাজি করে শেয়ারের মূল্য অতিমূল্যায়িত করেছিল কোম্পানিটি।

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তির মুখে কোম্পানিটি অনেক দেনদরবারের পরে শেয়ারপ্রতি ৫৪ হাজার টাকা হিসাবে প্রায় ৫৪০ কোটি টাকা দেশে নিয়ে যায়।  অপর একটি কোম্পানি ১০০ টাকার বিপরীতে ২৯ হাজার টাকা নিয়ে গেছে। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপত্তির মুখে বিদেশী কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমাফিক অর্থ দেশে নিতে পারেনি। এখন আর সে সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকবে না।

রও পড়ুন…

পুঁজিবাজার ক্যাসিনোতে পরিণত হয়েছে: আমির খসরু মাহমুদ 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ ফিরিয়ে নেবার অবারিত সুযোগ দেয়ার পেছনে নানা যুক্তি দাঁড় করানো হয়। বলা হয়, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। তারা বলে থাকেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে তা প্রত্যাহার করা অনেক জটিল। কিন্তু ওই সূত্র জানিয়েছে, দেশের বিদ্যমান বৈদেশিক বিনিয়োগ নীতিমালা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় মোটেই কঠিন বা জটিল নয়।

বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শিথিলতা রয়েছে। কিন্তু এরপরেও নেতিবাচক প্রচারণা থেকে মুক্ত থাকার যুক্তি দেখিয়ে ও সরকারি দলীয় সমর্থক একটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্ণধারের সুপারিশে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিধি নিষেধ তুলে দেয়ার পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা আর থাকবে না, পাশাপাশি করোনা-পরবর্তী বিদেশী বিনিয়োগকারীরা দেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবেন।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগনীতিমালা অনুযায়ী, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মূলধন দেশে ফেরত নেয়ার ক্ষেত্রে হিসাবায়নের জন্য তিনটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। প্রথমে কোনো বিদেশী কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে কত টাকার সম্পদ আছে তা নির্ধারণের জন্য সম্পদের মূল্যভিত্তিতে (এনএভি) হিসাবায়ন করা হয়।

রও পড়ুন…

করোনার মধ্যেও প্রভিশন ঘাটতিতে পুঁজিবাজারের ৮ ব্যাংক 

দ্বিতীয়ত, কোনো বিদেশী কোম্পানি দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হলে ওই কোম্পানির মূল্য নির্ধারণ করা হয় সমজাতীয় তালিকাভুক্ত কোম্পানির পুঁজিবাজারের বাজারমূল্যের ভিত্তিতে। যেমন, এক্স নামক তালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রতিটি ১০ টাকার শেয়ারের বাজারমূল্য ৫০ টাকা। তাহলে ওয়াই নামক কোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানি তার সম্পদ হিসাবায়নের ক্ষেত্রে এক্স নামক কোম্পানির বাজারমূল্যের সাথে তুলনা করে মূল্য নির্ধারণ করতে পারে। তৃতীয়ত, কোনো কোম্পানির বিগত ৫ থেকে ১০ বছরের গড় আয়ের সাথে তুলনা করে বিনিয়োগকৃত অর্থ হিসাবায়ন করা হয়।

সূত্র জানায়, বিদেশী কোম্পানিগুলোর নিট সম্পদ হিসাবের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় নয়-ছয় করার অভিযোগ পাওয়া যায়। যেমন জমির মূল্য ৫ থেকে ১০ গুণ বাড়িয়ে দেখানো হয়। ১ কোটি টাকার জমির অনেক ক্ষেত্রে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত করা হয়। বিভিন্ন ব্যয়কে আয় হিসেবে ধরে সম্পদকে অতিমূল্যায়িত করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিদেশী কোম্পানিগুলো তাদের সম্পদ অতিমূল্যায়িত করে নিজ দেশে যাতে নিয়ে যেতে না পারে সে জন্য বৈদেশিক মুদ্রা নীতিমালা অনুযায়ী বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা ছিল। এর মধ্যে ছিল, কোনো বিদেশী বিনিয়োগকারী বাংলাদেশ থেকে কোনো মূলধন মুনাফাসহ নিয়ে যেতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেবার বাধ্যবাধকতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যাচাই-বাছাই করে সম্পদ প্রস্থানের অনুমোদন দিতো।

কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চলাকালীন সময়ে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার যুক্তি দেখিয়ে নীতিমালা শিথিল করার পর বলা হয়েছে নিট অ্যাসেট ভ্যালু নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় কোনো বিনিয়োগকারী এক কোটি টাকার সমপরিমাণ বিদেশী সম্পদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই নিজ দেশে নিতে পারবেন। আর ১ কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আগে দেশে নিতে পারবে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে।

অপর দিকে, নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী সম্পদের প্রকৃত মূল্যের ভিত্তিতে যেকোনো পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে নিয়ে যেতে পারবে। সম্পদ নিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকে শুধু প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে। যেমন, সম্পদ ফিরিয়ে নেয়ার সময় বিনিয়োগকৃত কোনো সম্পদ হিসাবায়নের ক্ষেত্রে অতিমূল্যায়িত করা যাবে না। কৃত্রিমভাবে কোনো সম্পদের মূল্য বাড়ানো যাবে না। কিন্তু নীতিমালা শিথিল করায় সম্পদ ফিরিয়ে নেয়ার আগে কোনো সম্পদ অতিমূল্যায়িত করে নিয়ে যাচ্ছে কি না তা যাচাই বাছাই করার সুযোগ নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কোনো বিদেশী কোম্পানি তাদের সম্পদ অতিমূল্যায়িত করে অর্থ নিজ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক আপত্তি করলে ওই অর্থ ফিরিয়ে আনা যাবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সম্পদ নিয়ে যাওয়ার পর যাচাই বাছাই করা হলে কার্যত তখন করার কিছুই থাকবে না। এতে দেশ হারাবে জনগণের কষ্টে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা।