ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল: কোভিড সংক্রমণের এ অদ্ভুত সময়টায় আমাদের দিনগুলো কেমন যেন উল্টেপাল্টে গেছে। বদলে গেছে দিন আর রাত। প্রতিদিনের অভ্যাসগুলো আর আমাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ধরনগুলোও। আমরা এখন অফিস করি বাসায় বসে, বাজার করি সেটিও অনলাইনে। শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করায় এই যে ইতিহাসের দীর্ঘতম সরকারি ছুটি, শুধু বাংলাদেশেই নয় বরং গোটা পৃথিবীতেই; তাতে ব্যক্তির পাশাপাশি রাষ্ট্রের ক্ষতির মাত্রাটাও কিন্তু অপূরণীয়। শুধু আমাদের সরকারই প্রথম পর্যায়ে কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ করেছেন ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি।

এ সময়টায়, বিশেষ করে হাসপাতালগুলোয়, স্বাস্থ্যসেবা অনেকটাই সংকুচিত করে আনা হয়েছে। এর কারণটি কিন্তু এই নয় যে, আমাদের সহকর্মীরা, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা তাদের দায়িত্ব পালনের জায়গাগুলো থেকে সরে এসেছেন। বরং প্রতিদিন আমাদের অনেক সহকর্মী কর্মক্ষেত্রে কোভিড সংক্রমিত হয়ে দফায় দফায় প্রমাণ করছেন, ‘কাদম্বিনী মরে নাই’।

হাসপাতাল সেবা সংকুচিত করার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে যাতে এ সময়টায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের কোভিড সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায় এবং প্রয়োজনে কোভিড রোগীদের সেবায় তাদের আরও বেশি সংখ্যায় কাজে লাগানো যেতে পারে। পাশাপাশি তারা যদি সংক্রমিত হন, তাহলে তারা যে শুধু তাদের পরিবার-পরিজনকেই সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলবেন তা-ই নয়, বরং তারা হয়ে উঠতে পারেন ‘সুপার স্প্রেডার’; অর্থাৎ তাদের থেকে এ রোগ খুবই দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে অন্যান্য রোগীসহ হাজারও মানুষের মাঝে।

কিন্তু তাই বলে রোগ-শোক তো থেমে থাকে না। সাধারণ রোগীদের এখনও সুযোগ নেই আগের মতো হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার। করোনাকালে আমাদের জীবনে আরও অনেক নতুনের মধ্যে অন্যতম সংযোজনটি হচ্ছে টেলিমেডিসিন। এজন্য এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া আর বেশকিছু নাগরিক ও সামাজিক সংগঠন। ঘরে বসেই নাগরিক সুযোগ পাচ্ছেন টেলিফোনে চিকিৎসাসেবা নেয়ার। সরকারের স্বাস্থ্য বাতায়নে প্রতিদিন হাজারও ফোন আসছে। এগিয়ে এসেছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক-বাহক দেশের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে বেশ কয়েকটি সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন।

সম্প্রীতি বাংলাদেশের উদ্যোগে গঠন করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের ৮৭ সদস্যের একটি প্যানেল আর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির চিকিৎসা সহায়তা কমিটির চিকিৎসকদের প্যানেলে আছেন ১০৮ জন বিশেষজ্ঞ। এ গিয়ে এসেছে রোটারিও। ঢাকার রোটারি ক্লাব অব ঢাকা জেনারেশন নেক্সট প্রকাশ করেছে ২৪ জন বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তালিকা। ফোরাম ফর দি স্টাডি অব দ্য লিভার বাংলাদেশের উদ্যোগটি অবশ্য একটু অন্য রকমের।

সঙ্গত কারণেই তাদের তালিকায় শুধু লিভার বিশেষজ্ঞদের নাম। সংখ্যাটি ৫২। শুধু এ চারটি সংগঠন মিলেই প্রকাশ করেছে ২৭০ জন নানা বিষয়ে বিশেষজ্ঞের তালিকা। জাতীয় একটি দৈনিকে ফোরাম ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লিভার বাংলাদেশের এ উদ্যোগটি নিয়ে একটি উপসম্পাদকীয় কলামও প্রকাশিত হয়েছে। এসব বিশেষজ্ঞের মোবাইল নম্বর, বিশেষায়নের ক্ষেত্র এবং টেলি-কনসালটেশনের সময়সূচি প্রকাশ করা হয়েছে জাতীয় দৈনিকগুলো, অনলাইন আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। এসব নম্বরে ফোন করে প্রতিদিন হাজারও মানুষ চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ গ্রহণ করছেন।

টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে মানুষ যে শুধু স্বাস্থ্যসেবাই পাচ্ছে তা-ই নয়, সরাসরি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসককে দেখানোর প্রয়োজন থাকছে না বলে এ সময়টায় এ ধরনের ব্যবস্থা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখায় এবং হাসপাতালগুলোয় নন-কোভিড রোগীদের চাপ কমিয়ে রাখায় সহায়ক হচ্ছে। আর কোভিড-উত্তর সময়ে যদি এটি অব্যাহত রাখা যায়, সেক্ষেত্রে এর সুফল হবে সুদূরপ্রসারী। কারণ এতে রোগীদের আর্থিক সাশ্রয় হবে, বাঁচবে মূল্যবান শ্রমঘণ্টা, কমবে যানজট আর বাঁচবে পরিবেশও। সবচেয়ে বড় কথা, এটি দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে; কারণ তখন মানুষ জেলা-উপজেলায় বসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বড় শহরের ডাক্তারের সঙ্গে টেলিমেডিসিনেই যুক্ত হতে পারবেন।

সারা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও নিশ্চয়ই আমরা দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমরা সুদিনের প্রত্যাশায় আছি। আঁধার কেটে সূর্য হাসবেই। অপেক্ষা শুধু সময়ের। একাত্তরে সূর্যের প্রতীক্ষায় আমরা পার করেছিলাম একটি নববর্ষ, একটি রমজান, একটি শারদীয় দুর্গোৎসব, দুটি ঈদ আর নয়টি দীর্ঘ মাস। তারপর একসময় সূর্য হেসেছিল। হাসবে এবারও। কাজেই ধৈর্য একটু ধরতেই হবে। আর এ কঠিন সময়টায় সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা পাওয়া আর ভালো থাকাটা আরেকটু সহজ করতেই বাংলাদেশের সরকার-চিকিৎসক-রাজনীতিবিদ-সুশীলসমাজের এসব উদ্যোগ।

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়; সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ