দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এমআই সিমেন্টের পরিচালকদের বিনিয়োগকারীদের টাকাই ব্যক্তিগত ছয়টি কোম্পানি গড়ে তুলছেন। এজন্য  এমআই সিমেন্ট থেকে দীর্ঘদিন ধরে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের বিভিন্ন কোম্পানিতে শত কোটি টাকার ওপরে বিনাসুদে ঋণ দেয়া হয়েছে। কোম্পানির হাজার হাজার শেয়ারহোল্ডার বা মালিক থাকলেও তাদের অনুমোদন না নিয়েই এ অর্থ দেয়া হয়। এর মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে পরিচালকদের ব্যক্তিগত ছয়টি কোম্পানি। এ অপরাধে সম্প্রতি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোম্পানির পাঁচ পরিচালককে ১০ লাখ টাকা করে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে।

রও পড়ুন…

ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ-সিডিবিএলের যোগসাজসেই বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ! 

২০১৮-১৯ অর্থবছরের আর্থিক হিসাব অনুযায়ী, এমআই সিমেন্টে শেয়ারহোল্ডারের সংখ্যা ২৮ হাজার ১৭৬ জন। আর এ কোম্পানি থেকে তাদের অনুমোদন না নিয়েই উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ৬ কোম্পানিতে বিনাসুদে টাকা দেয়া হয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে পরিচালকদের ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করা হয়েছে। তারপরেও সেই প্রদত্ত অর্থ অনিরাপদ এবং অর্থ ফেরতে নির্দিষ্ট কোনো শর্ত নেই বলে আর্থিক হিসাবে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তবে এমআই সিমেন্টের কোম্পানি সচিব মজহারুল ইসলামের দাবি পরিচালকদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে বিনা সুদে ঋণ দেয়া হয়নি। কোম্পানির জন্য পণ্য কিনতে অগ্রিম টাকা দেয়া হয়েছে।

রও পড়ুন…

এ বিষয়ে তিনি বলেন, পরিচালকদের কোম্পানিগুলো আমাদের মূল সিমেন্ট কোম্পানিকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য। যেমন- সিমেন্ট বাজারজাত করার জন্য ব্যাগ লাগে, এ ব্যাগের জন্য আমাদের আলাদা একটা কোম্পানি আছে। ওই ব্যাগ নেয়ার জন্য আমরা অগ্রিম টাকা দিয়েছি। এটাকে তারা (বিএসইসি) বলছে সুদবিহীন ঋণ। এখন তারা কোনো মতেই মানছে না, না মানলে তো কিছু করার নেই।

তিনি আরও বলেন, এটা সুদবিহীন ঋণ নয়, এটা মাল কেনার জন্য অ্যাডভান্স (অগ্রিম)। এটা ঋণ না হওয়ার কারণে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নেয়া হয়নি। আমরা আমাদের অন্যান্য ভেন্ডরদের যেমন অ্যাডভান্স দেই, এটাও আমাদের একটা ভেন্ডর। আমরা যদি ঋণ দিতাম তাহলেই অ্যাপ্রুভালের (অনুমোদন) প্রশ্নটা আসতো।

রও পড়ুন…

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এমআই সিমেন্ট থেকে অর্থ দেয়া পরিচালকদের মালিকানাধীন কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- ক্রাউন পাওয়ার জেনারেশন, ক্রাউন পলিমার ব্যাগিং, ক্রাউন সিমেন্ট কনক্রিট অ্যান্ড বিল্ডিং প্রডাক্টস, ক্রাউন ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস, ক্রাউন সিমেন্ট ট্রেডিং কোম্পানি ও ক্রাউন মেরিনার্স।

এর মধ্যে ২০০৯-১০ অর্থবছর পর্যন্ত গঠিত ছিল শুধুমাত্র ক্রাউন পাওয়ার জেনারেশন, ক্রাউন পলিমার ব্যাগিং ও ক্রাউন মেরিনার্স। ২০১০-১১ অর্থবছরে গঠন করা হয় ক্রাউন সিমেন্ট ট্রেডিং কোম্পানি, ক্রাউন সিমেন্ট কনক্রিট অ্যান্ড বিল্ডিং প্রডাক্টস ও ক্রাউন ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস।

কোম্পানিগুলোতে অর্থ প্রদানের বিভিন্ন উদ্দেশ্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আর্থিক হিসাবে উল্লেখ করেছে এমআই সিমেন্ট কর্তৃপক্ষ। যেখানে ক্রাউন পাওয়ার জেনারেশন থেকে বাজার দরের থেকে কম দামে এমআই সিমেন্টে পাওয়ার সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছে।

এছাড়া ক্রাউন পলিমার ব্যাগিং থেকে কম দামে ব্যাগ সরবরাহ, ক্রাউন ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস থেকে এমআই সিমেন্টের পণ্য গ্রাহকদের কাছে কম দামে পৌঁছানো ও ক্রাউন মেরিনার্সের মাধ্যমে চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে কাচাঁমাল কারখানায় পৌঁছানোর কথা বলা হয়েছে। আর ক্রাউন সিমেন্ট কনক্রিট অ্যান্ড বিল্ডিং প্রডাক্টস কোম্পানির মাধ্যমে সিমেন্ট মিক্সের কাজ করা হয়। যা ক্রাউন সিমেন্টের কাজ বিশেষভাবে করে। এছাড়া ক্রাউন সিমেন্ট ট্রেডিং কোম্পানি মাঝে মধ্যে সিমেন্ট ব্যবসা করে।

২০১৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত কোম্পানিগুলোতে এমআই সিমেন্টের দেয়া অর্থের পরিমাণ দাড়াঁয় ১৭২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। যার পরিমাণ ২০১৭ সালের ৩০ জুন ছিল ৯১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ওই সময়ের মধ্যে ৮১ কোটি ৬ লাখ টাকা দেয়ার মাধ্যমে এ পরিমাণে বৃদ্ধি করা হয়।

পরিচালকদের ছয় কোম্পানিতে এমআই সিমেন্ট থেকে ২০০৯ সালের ৩০ জুন বিনাসুদে দেয়া ঋণ ছিল আট কোটি ৬৯ লাখ টাকা। যা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১০ সালের ৩০ জুন ১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, ২০১১ সালের ৩০ জুন ৩৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ২০১২ সালের ৩০ জুন ৫১ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ২০১৩ সালের ৩০ জুন ৬৮ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, ২০১৪ সালের ৩০ জুন ৮৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, ২০১৫ সালের ৩০ জুন ৯১ কোটি ৯১ লাখ টাকা ও ২০১৬ সালের ৩০ জুন ৯৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা হয়।

এরপরে অর্থ আদায়ের মাধ্যমে ২০১৭ সালের ৩০ জুন ৯১ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ২০১৮ সালের ৩০ জুন ৪৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা ও ২০১৯ সালের ৩০ জুন কমে ২৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকায় নেমে আসে। আর ২০২০ সালের ৩১ মার্চ পরিচালকদের ওই ৬ কোম্পানিতে দেয়া অর্থের পরিমাণ এখনো ১১ কোটি ৮২ লাখ টাকা রয়েছে।

এই অর্থ প্রদানের অনিয়মের কারণে গত ২৩ জুন কমিশন সভা করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এমআই সিমেন্টের প্রত্যেক পরিচালককে (স্বতন্ত্র ও মনোনিত ব্যতিত) ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ কোম্পানিতে স্বতন্ত্র ব্যতীত পাঁচজন পরিচালক রয়েছেন।

বিএসইসি জানিয়েছে, এমআই সিমেন্ট ফ্যাক্টরি তাদের ২০১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সমাপ্ত প্রথম প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে ‘কারেন্ট অ্যাকাউন্ট উইথ দ্যা সিস্টার কনসার্ন’হিসাব শিরোনামে ৭০ কোটি ৪০ লাখ টাকা দেখিয়েছে। যা প্রকৃতপক্ষে ইস্যুয়ার কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুদবিহীন ঋণ হিসেবে প্রদত্ত হয়েছে এবং উক্ত ঋণ প্রদানের পূর্বে কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় অনুমোদন নেয়া হয়নি।

এছাড়া কোম্পানির আগের বছরগুলোর নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনেও সুদবিহীন ঋণ দেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ইস্যুয়ার কোম্পানির পরিচালকদের শতভাগ মালিকানাধীন। এক্ষেত্রে কোম্পানি এমআই সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লিমিটেড কমিশনের প্রজ্ঞাপন (নং এসইসি/সিএমএমআরআরসিডি/২০০৬-১৫৯/অ্যাডমিন/০২-১০) লঙ্ঘন করেছে। যে কারণে কোম্পানির পরিচালকদের জরিমানা করা হয়েছে।

আর্থিক হিসাব অনুযায়ী, পরিচালকদের ব্যক্তিগত ৬ কোম্পানিতে অর্থ প্রদান করে এমআই সিমেন্টের ক্ষতি হয়েছে দুই কোটি ৯ লাখ টাকা। ৩১ মার্চ ২০২০ সালের প্রকাশিত হিসাবে, ইমপেয়ারম্যান্ট অ্যালাউন্স হিসেবে এই ক্ষতি দেখানো হয়েছে। যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গঠন করা হয়েছে।

বিনাসুদে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি ওই ৬ কোম্পানির মধ্যে চারটিতে বিনিয়োগ করা হয়েছিল এমআই সিমেন্ট থেকে। এর মধ্যে ক্রাউন পাওয়ারে ২০ লাখ টাকা, ক্রাউন মেরিনার্সে এক কোটি ৭২ লাখ টাকা, ক্রাউন সিমেন্ট কনক্রিট অ্যান্ড বিল্ডিং প্রডাক্টসে পাঁচ লাখ টাকা এবং ক্রাউন ট্রান্সপোর্টেশনে পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল।

ক্রাউন সিমেন্ট কনক্রিট অ্যান্ড বিল্ডিং প্রডাক্টসে ও ক্রাউন ট্রান্সপোর্টেশনে বিনিয়োগের পুরোটা ২০১০-১১ অর্থবছরে করা হয়। এছাড়া ক্রাউন মেরিনার্সে নতুন করে এক কোটি ৬৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়। এ চার কোম্পানির মধ্যে ক্রাউন পাওয়ারে ৫০ শতাংশ ও অন্য কোম্পানিগুলোতে ২০ শতাংশ করে মালিকানায় বিনিয়োগ করা হয়।

এই চার কোম্পানির বিনিয়োগের মধ্যে লোকসানে ক্রাউন মেরিন ছাড়া বাকি ৩ কোম্পানির বিনিয়োগ শূন্য হয়ে যায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে। তবে মেরিন ক্রাউন মুনাফা করে। যাতে এক কোটি ৭২ লাখ টাকার বিনিয়োগ ২০১৯ সালের ৩০ জুন বেড়ে দাড়িঁয়েছে ২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকায়। এছাড়া ক্রাউন পাওয়ার মুনাফায় ফেরায় বিনিয়োগ ৮২ লাখ টাকা হয়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক সদস্য বলেন, আইনের দুর্বলতার কারণে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানি বড় অপরাধ করে ছোট শাস্তি পায়। এরপরও বলতে হচ্ছে সম্প্রতি এমআই সিমেন্টসহ একাধিক কোম্পানিকে জরিমানা করে নতুন কমিশন সহসের পরিচয় দিয়েছে। বিএসইসির এই পদক্ষেপ অব্যাহত থাকলে শেয়ারবাজারের ওপর আবার আস্থা ফিরে আসবে।