দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: করোনা পজিটিভ রোগীদের নেগেটিভ ফল জানতে দ্বিতীয় দফায় আর পরীক্ষা করা হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, করোনাভাইরাস পরীক্ষায় পজিটিভ হওয়ার ১৪ দিন পর যদি সুস্থ হয়ে যান, করোনার লক্ষণ বা উপসর্গ না থাকে, তাহলে দুটি আরটিপিসিআর পরীক্ষায় যে নেগেটিভ ফল আসতে হতো, সেটির আর দরকার নেই। এর ফলে এখন থেকে করোনা রোগীদের নেগেটিভ নিশ্চিত হতে দ্বিতীয় দফা পরীক্ষা করা হবে না এবং সুস্থ হওয়ার পরপরই রোগীদের হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

গত সপ্তাহে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) গবেষকরা ‘কভিড-১৯ পজিটিভ ব্যক্তি চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার পর তার আর টেস্ট করার দরকার হবে না’ এমন গাইডলাইন চূড়ান্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানান। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিষয়টি জনসমক্ষে খোলাসা করেনি অধিদপ্তর। অবশ্য সরকারি হাসপাতালে এখন রোগীদের নেগেটিভ পরীক্ষা করা হচ্ছে না।

যদিও গতকাল নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে অধিদপ্তর প্রথমবারের মতো এ ব্যাপারে এক ধরনের নির্দেশনা দিয়েছে; সেখানেও অস্পষ্টতা রয়েছে। কারণ সেখানে কর্মজীবীদের ব্যাপারে বলা হয়েছে ‘অনেকেই সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও কাজে ফিরতে তাদের অসুবিধা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যে কেউ কভিড-১৯ পজিটিভ হলে তিনি অবশ্যই ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকবেন এবং লক্ষণ-উপসর্গমুক্ত হলে তিনি আরও ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থেকে স্বাভাবিক কাজে ফিরবেন।

যদিও ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সিডিসি আটলান্টা এ সময়টিকে ১০ দিন বলেছে, তবুও অতিরিক্ত সতর্কতা বিবেচনায় এখানে ১৪ দিন বলা হচ্ছে। সুতরাং যারা নিয়োগকারী সংস্থা/কর্র্তৃপক্ষ, তারা এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাদের কভিড-১৯ পজিটিভ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে ফিরতে সহায়তা করবেন। এ ক্ষেত্রে আর কোনো পরীক্ষার দরকার হবে না।’ তবে সেখানে সাধারণ রোগীদের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।

জনসমক্ষে বা গণমাধ্যমে প্রকাশ না করলেও অধিদপ্তর সপ্তাহখানেক আগেই বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালকে নতুন গাইডলাইন অনুযায়ী পরীক্ষা ও চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছে। ইতিমধ্যেই সরকারি হাসপাতাল সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন শুরু করেছে এবং রোগী সুস্থ হয়ে গেলে নেগেটিভ পরীক্ষা ছাড়াই হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিচ্ছে। এর ফলে রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে এবং নেগেটিভ পরীক্ষার ফল না থাকায় অন্য রোগের জন্য পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে আরেক দফা ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে রোগীদের। তবে বেসরকারি হাসপাতাল সংক্রমণ ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে রোগীদের দ্বিতীয় দফা নেগেটিভ পরীক্ষা করছে।

আইইডিসিআর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে নতুন গাইডলাইনে সুস্থ হওয়া ব্যক্তি থেকে নতুন করে সংক্রমণের কোনো ঝুঁকি নেই বলছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা নেগেটিভ পরীক্ষা না করেই ছেড়ে দেওয়া ব্যক্তি থেকে অন্যদের সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন।

এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, এটা গ্লোবাল প্রটোকল। আমাদের এখানে আমরা বেশ কিছুদিন ধরে মানার চেষ্টা করছি। আজ (গতকাল) প্রেস ব্রিফিংয়ে তো বলেছে ১৪ দিন পর আর টেস্ট করার প্রয়োজন নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তাদের সাম্প্রতিক গাইডলাইনে এ নির্দেশনা দিয়েছে। এটা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হবে, সেজন্য সময় লাগছে। গাইডলাইন হয়ে গেছে। হাসপাতালগুলো সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিচ্ছে।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, এতে কোনো সংকট নেই। যেহেতু প্রথমদিকে প্রটোকল ছিল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরপর দুটি টেস্ট নেগেটিভ হলে সে সুস্থ এবং এখনো বিভিন্ন অফিসে নেগেটিভ রেজাল্ট চায়, সেজন্য আমরা আজ (গতকাল) বিষয়টি জানিয়েছি। সুস্থ হওয়ার পর টেস্টের প্রয়োজন নেই। মানুষকে যেন কেউ হয়রানি না করে। তাহলে সংক্রামক ব্যাধি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

টেস্ট ছাড়া মুক্ত ঘোষণা করা ব্যক্তিদের দ্বারা সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, তারা ছড়াতে পারে না। কারণ গ্লোবালি দেখা গেছে সুস্থ হওয়ার ১০ দিন পর ছড়ায় না। আমরা এটাকে ১৪ দিন পর্যন্ত রেখেছি। আমেরিকায় ১০ দিন পরই ছেড়ে দেয়। পরপর তিন দিন প্যারাসিটামল ছাড়াই জ¦র না থাকে, তাহলে ১১তম দিনে চলে যেতে বলে।

তবে ভিন্নমত পোষণ করেছেন করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, এ ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই সিদ্ধান্ত নেবে, তবে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর। কারও ভাইরাস আছে, সে সময় বাসায় চলে গেল। তখন ছড়াবে। কারণ হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর বাসায় আইসোলেশন নিশ্চিত করা কঠিন। এটা যদি কিটের সংকট ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার অভাবে করে থাকে, তাহলে পরে বিপদে পড়বে। এ বিশেষজ্ঞ বলেন, একজন ভাইরোলজিস্ট হিসেবে মনে হয় দ্বিতীয়বার টেস্ট করাই উচিত।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেনও বলছেন আশঙ্কার কিছু নেই। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আগে ১৪ ও ১৫ দিনের দিন দুটি নেগেটিভ টেস্টের জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম। সেটা লাগছে না। কারণ সুস্থ হওয়া মানেই তার নেগেটিভ। যদিও কারও পজিটিভ হয়, সেটা ‘মৃত ভাইরাস’। এ বিশেষজ্ঞ বলেন, পজিটিভ রোগীরা সুস্থ হওয়ার পর তিন দিন আমরা তাদের অপেক্ষা করতে বলি। জ¦র ছেড়ে যাওয়ার পর তিন দিন যদি প্যারাসিটামল ছাড়াই জ¦র না থাকে, সে সুস্থ বলে গণ্য। এরপরও যদি সে পজিটিভ হয়, তাহলে ‘নন ইনফেকটিভ’। অর্থাৎ সে কাউকে রোগ ছড়াতে পারবে না। এ সময় সে ‘সুস্থ’ না, করোনামুক্ত বলে গণ্য হবে। কারণ তার মধ্যে করোনার কারণে অন্য রোগের জটিলতা বাড়তে পারে। সে কারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের গাইডলাইন সংশোধন করেছে।

অবশ্য আশঙ্কার কথা বলছেন বেসরকারি ‘হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের’ চেয়ারম্যান ও প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, দুটো প্রটোকল ছিল। প্রথমে বলা ছিল, পরপর দুটি পরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষায় নেগেটিভ এলে ছাড়তে হবে। এখন বলছে যে, ভালো হয়ে গেলে অর্থাৎ পজিটিভ হওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে (টেস্টের দিন থেকে) রোগী যদি ভালো হয়ে যায় এবং তার কোনো লক্ষণ না থাকে, ডিজি হেলথ বলছে তাকে ছেড়ে দিতে। সে যেন আইসোলেশনে থাকে। এ সংক্রান্ত একটা গাইডলাইন এসেছে। এ বিশেষজ্ঞ বলেন, সাধারণ রোগীরা বুঝতে পারছে না কখন তার বাড়ি যাওয়া উচিত। নেগেটিভ পরীক্ষা ছাড়াই তাকে ছেড়ে দিলে সে হাসপাতাল ও ডাক্তারের ওপর বিরূপ হয়। সে ভাবছে, তার থাকা উচিত কিন্তু ডাক্তার রাখছে না। এ জাতীয় মতভিন্নতা দেখা দেয়।

নতুন গাইডলাইনে শঙ্কার কথা বলছেন ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, সব রোগীই কিন্তু উপসর্গ কমে গেলে নেগেটিভ হয় না। কারও কারও পজিটিভ থাকে। ফলে যদি টেস্ট না করে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে যদি পজিটিভ থাকে, এরা বাসায় রোগ ছড়ানোর একটি মাধ্যম হয়ে যেতে পারে। কারণ হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়ার পর আবার ১৪ দিন আলাদা থাকবে, এটা অনেকের ধৈর্যে কুলাবে না। বাসায় সে সুযোগও নেই। ফলে টেস্ট না করে ছুটি দিলে একটি ভয়ের দিক থেকে যায় যে মানুষটি বাসায় গিয়ে আবার রোগ ছড়াতে পারে।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, আমরা যেটি করি, রোগী সুস্থ হয়ে গেল, তার উপসর্গ নেই, এর দুদিন পর পরীক্ষা করি। আবার কোনো রোগী যদি সাত দিনে সুস্থ হয়ে যায়, তাকেও কিন্তু ১৪ দিন পর পরীক্ষা করি। দ্বিতীয় পরীক্ষার জন্য মাত্র দুদিন বেশি সময় হাসপাতালে রাখতে হয়। এ অল্প সময়ের জন্য টেস্ট ছাড়াই রোগী ছেড়ে দেওয়া ঝুঁকি নেওয়া হচ্ছে বলে আমি মনে করি। আমার পরামর্শ শতভাগ ভালো হয়ে গেছে এমন নিশ্চিত হওয়ার পরই ছুটি দেওয়া উচিত এবং সে ক্ষেত্রে নেগেটিভ পরীক্ষা করাটাই ভালো।

এদিকে সরকারি হাসপাতালে নতুন গাইডলাইন অনুযায়ী সুস্থ হওয়ার পর নেগেটিভ পরীক্ষা ছাড়াই রোগীদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রোগী সুস্থ হয়ে গেলে, পরপর তিন দিন যদি তার কোনো উপসর্গ না থাকে, তাহলে তাকে সুস্থ বিবেচনা করে ছেড়ে দিচ্ছেন। এতে পরীক্ষা ও বেডের সাশ্রয় হচ্ছে। তবে বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তারা নেগেটিভ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েই রোগী ছাড়ছেন।

নেগেটিভ রিপোর্ট ছাড়া অন্য রোগের চিকিৎসায় হাসপাতালে ভর্তি হতে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের। হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা হাসপাতালে এখন দ্বিতীয় টেস্ট করছে না। দ্বিতীয় টেস্ট না করেই রোগীদের হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে দিচ্ছেন। ফলে অন্যরা তেমন সমস্যায় না পড়লেও ক্যানসারসহ জটিল রোগীরা বেশ দুর্ভোগে পড়ছেন। ক্যানসার রোগীরা করোনা হাসপাতাল থেকে ছাড় পেয়ে ক্যানসার হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি কিংবা চিকিৎসা নিতে পারছেন না। ক্যানসার হাসপাতালগুলো করোনা নেগেটিভ রেজাল্ট ছাড়া কোনোভাবেই চিকিৎসা দিতে চাচ্ছে না। তারা রোগীদের নেগেটিভ রেজাল্টের জন্য করোনা হাসপাতালে পাঠাচ্ছে। রোগীরা প্রতিদিন করোনা হাসপাতালের সামনে এসে ভিড় ও অপেক্ষা করছেন। ফলে এর একটা সমন্বয় দরকার। সেটা না হলে রোগীদের দুর্ভোগ বাড়বে।

এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, গাইডলাইনটা ঠিক আছে। পরে যে নেগেটিভ পরীক্ষা সেটার প্রয়োজন নেই। একটি লোক উপসর্গবিহীন হয়ে গেলে সে ভালো হয়ে যায়। আমাদের দেশেই শুধু এটা ছিল। আশপাশে, এমনকি ভারতেও নেই। তাদের বাসায় থাকতে বলা হয়। বেশি নড়াচড়া করতে নিষেধ করা হয়। নিজেকে একটু আবদ্ধ থাকতে বলা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যে নেগেটিভ রিপোর্ট চাইছে বিভিন্ন হাসপাতাল, সেটা সে চাইতে পারে না। এখন যেটা নিয়ম, নেগেটিভ বা পজিটিভ যেটাই থাকুক, রোগী ভর্তি করাতে হবে। ভর্তি করার পর উপসর্গ অনুযায়ী পরীক্ষা করানোর দরকার হলে করাবে। তা না হলে যে রোগ, সেটার চিকিৎসা করবে। এ গাইডলাইনটা ডিজিটাল প্রকাশ করতে পারে। মানুষের ভোগান্তি কমানোর জন্য এটা তাদের প্রচার করতে হবে। সুত্র: দেশ রূপান্তর