ষ্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: রপ্তানির ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে বাংলাদেশ। সদ্য সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি কমেছে এর আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬৮৬ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা। রপ্তানিকারকরা বলছেন, এত বেশি পরিমাণে রপ্তানি কমে যাওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, গত অর্থবছরে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। অন্যদিকে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রপ্তানি কমেছে ২৬ শতাংশ।

বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রভাবে এই অবস্থা দাঁড়িয়েছে। যদিও করোনার আগে থেকেই রপ্তানিতে ধারাবাহিকভাবে কিছুটা ঋণাত্মক গতি ছিল। করোনা সেই অবস্থাকে আরও নাজুক করে তুলেছে। গত অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। আগের অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫৪ কোটি ডলার।

রও পড়ুন…

 বিএসইসি নগদ লভ্যাংশ প্রদানে বিইএফটিএন বাধ্যতামূলক করে দিচ্ছে 

২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৭৮৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। আগের অর্থবছরে পোশাক পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলার। সেই হিসাবে কেবল পোশাক পণ্য রপ্তানিই কমেছে ৬৩০ কোটি ডলার। অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি কম হয়েছে ১ হাজার ১৮৩ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ৫৫০ কোটি ডলারের। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত জুন মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ২৭৮ কোটি ৪৪ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক মে মাসের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ এবং এপ্রিল মাসের চেয়ে সাড়ে পাঁচ গুণ বেশি।

গত অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্য ছিল ৩৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তৈরি পোশাক থেকে আয় হয়েছিল ৩৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে গত অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে এ খাতে আয় কমেছে ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের চেয়ে আয় কমেছে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ওভেন পোশাক থেকে আয় হয়েছে ১৪ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

রও পড়ুন…

গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে চীনে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আনা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাতে ফেব্রুয়ারি থেকেই প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল। এরপর শুরু হয় ক্রয়াদেশ বাতিলের হিড়িক। মার্চ মাসে এসে রাপ্তানির অঙ্কে ধস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই মাসে ২২৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা আগের বছরের মার্চের চেয়ে ২০ শতাংশ কম ছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) মধ্যে সেটিই ছিল বড় ধাক্কা।

ইপিবি’র তথ্যে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছিল ৮৫ শতাংশ। মে মাসে কমে ৬১ শতাংশ। আর সর্বশেষ জুনে কমেছে ২৫ শতাংশ। জুন মাসে রপ্তানি হয়েছে ২৭১ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের পণ্য। লক্ষ্য ছিল ৩৯৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয় হয়েছিল ২৭৮ কোটি ৪৪ লাখ ডলার।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এপ্রিল মাসের পুরোটা সময় পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতিও ছিল খুব খারাপ। সে কারণে এপ্রিলে রপ্তানি তলানিতে নেমে এসেছিল। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে মূল ভূমিকা থাকে তৈরি পোশাক শিল্পের; মে মাসে পোশাক কারখানাগুলোতে উৎপাদন হয়েছে। আগের ‘অর্ডার’ও ছিল। ইউরোপের দেশগুলোর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় রপ্তানিও কিছুটা বেড়েছে। তবে নতুন ‘অর্ডার’ না আসার পাশাপাশি অনেক ক্রেতা ‘অর্ডার’ বাতিল করেছে বলে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন। ফলে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কা জানিয়েছেন পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক।

এদিকে পোশাক খাতের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, চলতি মাসের কিছু ক্রয়াদেশ তার কারখানায় রয়েছে। কিন্তু আগস্ট থেকে পরবর্তী মাসগুলোর রপ্তানি আদেশ নেই বললেই চলে। সেপ্টেম্বর থেকে মূলত পরবর্তী গ্রীষ্মের রপ্তানির পণ্য তারা তৈরি করেন। এসব ক্রয়াদেশ নিয়ে মূলত এই সময়টিতে আলোচনা হয়। কিন্তু এবার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। রপ্তানির অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে আশঙ্কা করে তিনি বলেন, যতদিন পর্যন্ত পর্যটকের স্বাভাবিক চলাচল শুরু না হবে, ততদিন পোশাক জাতীয় পণ্য তেমন বিক্রি হবে না। ফলে আমাদের রপ্তানি আদেশও কমতির দিকেই থাকবে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বলছে, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বে পোশাকের চাহিদা ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে যাবে। এই সঙ্কটেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার আয় করেছে। এই অঙ্ক ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ৭ শতাংশ। ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের নয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ পর্যন্ত পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে ২৫ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি ছিল।

মহামারিকালে ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে সাড়ে ৪ শতাংশ। বাকি অন্য সব খাতেই কমেছে। চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। হিমায়িত মাছ রপ্তানি কমেছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানি কমেছে ১৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩৫ কোটি ৮২ লাখ (৪০.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। তাতে প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছিল ৪ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৪ হাজার ৫৫০ কোটি (৪৫.৫০ বিলিয়ন) ডলার।