ষ্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কর্মরত শীর্ষ পর্যায়ের বিশেষ করে প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তাসহ (সিটিও) সি-লেভেলের কর্মকর্তাদের অবদান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রতি মাসে ৫ লাখ টাকার ওপর বেতন নেওয়া সি-লেভেলের কর্মকর্তারা স্টক এক্সচেঞ্জ ও বাজার উন্নয়নে কী ভূমিকা রাখছেন, তা খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে। তাদের চুক্তিভিত্তিক পদগুলো স্থায়ী করার প্রায় সাত বছর পর এর যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ডিএসই মানবসম্পদ মূল্যায়নে গঠিত কমিটি।

রও পড়ুন…

চলতি বছরের ২ জুন ডিএসইর পর্ষদ সভায় এক্সচেঞ্জটির মানবসম্পদ মূল্যায়ন ও অন্যান্য ইস্যু পরীক্ষার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক সালমা নাসরিনের নেতৃত্বে গঠিত এ কমিটির অন্য চার সদস্য হলেন স্বতন্ত্র পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান, মো. মুনতাকিম আশরাফ, অধ্যাপক ড. এ কে এম মাসুদ এবং এক্সচেঞ্জটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ছানাউল হক। গত রবিবারের পর্ষদ সভায় কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে স্টক এক্সচেঞ্জটিতে সি-লেভেলের কর্মকর্তাদের অবদান নিয়ে প্রশ্ন রেখে তাদের ভূমিকা মূল্যায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।

রও পড়ুন…

ডিএসই শীর্ষ ৬ প্রভাবশালী বিরুদ্ধে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগের অভিযোগ! 

মূর‌্যায়ন কমিটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পর ডিএসইর প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তাসহ (সিটিও) সি-লেভেলের কর্মকর্তাদের পদটি ছিল চুক্তিভিত্তিক। কিন্তু ২০১৪ সালের ১৭ নভেম্বর কোনো এজেন্ডা বা বিশ্লেষণ ছাড়াই সি-লেভেলের চুক্তিভিত্তিক পদগুলো স্থায়ী পদে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় ডিএসইর তৎকালীন পর্ষদ। একই পর্ষদ সিএফও এবং সিটিও পদে নতুন পে-স্কেল দিয়ে নিয়মিত কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়। যার ফলে তারা চুক্তিকালের চেয়ে বেশি বেতনে নিয়োগ পান।

মানবসম্পদ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বোর্ডের সিদ্ধান্তে যেভাবে সি-লেভেলের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাতে স্টক এক্সচেঞ্জের স্বার্থরক্ষা হয়নি। একই সঙ্গে এটি এক্সচেঞ্জের অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেতন বৈষম্যও তৈরি করেছে। এভাবে সি-লেভেলের নিয়োগে পর্ষদের সিদ্ধান্ত এক্সচেঞ্জের সার্ভিস রুলের লঙ্ঘন। তদুপরি ২০১৭ সালে সি-লেভেলের জন্য পে ব্যান্ড নির্ধারণ করাও সমর্থনযোগ্য নয়। সি-লেভেলের পদগুলো স্থায়ী করার কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল তারা ডিএসই ও বাজারের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি এক্সচেঞ্জটির সর্বাধিক মুনাফা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন। তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে স্টক এক্সচেঞ্জটির অভ্যন্তরীণ সুশাসন উন্নত করবেন।

ডিএসইর আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৪-১৫ হিসাব বছরের পর থেকে স্টক এক্সচেঞ্জটির নিট মুনাফা ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০১৪-১৫ হিসাব বছরে ডিএসইর নিট মুনাফা ছিল ১৩৪ কোটি টাকা, যা ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ৯৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে ডিএসইতে অন্য কর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন না হওয়ায় মেধাবী কর্মকর্তারা স্টক এক্সচেঞ্জ ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।

এখন সি-লেভেলের কর্মকর্তাদের চাকরি স্থায়ী করার প্রায় সাত বছর তাদের অবদান নিয়ে প্রশ্ন তুলছে স্টক এক্সচেঞ্জটির মানবসম্পদ মূল্যায়ন কমিটি। উচ্চ বেতনে সি-লেভেলের কর্তাদের নিয়োগের পর থেকে ডিএসই তাদের কাছ থেকে কী পেয়েছে তা দ্রুত ও যথাযথ মূল্যায়ন করা প্রয়োজন বলে মনে করে কমিটি। সি-লেভেলের চুক্তিভিত্তিক পদগুলো স্থায়ী করায় ডিএসইর ওপর বড় ধরনের আর্থিক বোঝা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন কমিটি প্রধান। এ কারণে কমিটি আগের মতোই এ পদগুলোকে চুক্তিভিত্তিক করার সুপারিশ করেছে।

সি-লেভেলের কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ানোর ক্ষেত্রে পূর্বের রীতি ভাঙা হয়েছে। মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন বলছে ডিএসইর সিএফও এবং সিটিও যোগ দেওয়ার দেড় বছরের মধ্যে তাদের বেতন ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। যেখানে অন্য কর্মীদের বেতন বাড়াতে পাঁচ থেকে সাত বছর সময় নেওয়া হয়েছে। এক স্তর নিচের কর্মকর্তাদের তুলনায় সি-লেভেলের কর্মকর্তাদের বেতনের ব্যবধানও অস্বাভাবিক ও বিস্ময়কর। এক্সচেঞ্জটির জিএম পদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সি-লেভেলের কর্মকর্তাদের বেতনের ব্যবধান ১৫৩ শতাংশ। বর্তমানে সি-লেভেলের কর্মকর্তাদের মাসিক মোট বেতন হচ্ছে ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৬০ টাকা, যা একজন জিএম লেভেলের কর্মকর্তার সর্বোচ্চ বেতনের চেয়ে ৩ লাখ ৯ হাজার টাকা বেশি। যেখানে ডিজিএম থেকে জিএম লেভেলের কর্মকর্তাদের বেতনের ব্যবধান ২০ হাজার টাকা।

মানবসম্পদ মূল্যায়ন কমিটির হিসাবে ডিএসইতে বর্তমানে অতিরিক্ত জনবল রয়েছে ১৪২ জন, যাদের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব নেই। এই অতিরিক্ত জনবলের উল্লেখযোগ্য অংশই নিরাপত্তা, অফিস সহকারী, ইলেকট্রিক্যাল ও কিচেনের কাজে জড়িত। কমিটির প্রতিবেদন বলছে এক্সচেঞ্জটির একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের অধীনে ৩৫ জন জনবল রয়েছে, যাদের প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা যাচাই করা প্রয়োজন। ডিএসইর আইটি বিভাগে কর্মরতরা অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ওএসএস) সংক্রান্ত কাজ করছে। এ বিভাগে উল্লেখযোগ্য কর্মী থাকা সত্তে¡ও নাসডাককে বড় অঙ্কের অর্থ দিতে হচ্ছে। বিদেশি ভেন্ডর ও বিশেষজ্ঞের ওপর নির্ভরতা কমাতে আইটি বিভাগের নিজস্ব জনবলের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে কমিটি, যাতে এই বিভাগের কর্মীরা বিভিন্ন সফটওয়্যার ও সিস্টেম ডেভেলপ করতে পারে। অন্যদিকে ওটিসি বিভাগের অনেক কাজ থাকলেও এখানে মাত্র তিনজন জনবল রয়েছে।

এক্সচেঞ্জ কিংবা বাজারের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন কোনো গবেষণা ডিএসইর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের পক্ষ থেকে করা হয়েছে বলে খুঁজে পায়নি কমিটি। প্রডাক্ট ও মার্কেট বিভাগের কাছে ডাটা বিক্রি, ব্রোকার হাউজ পরিদর্শন করা, প্রশিক্ষণে সহায়তা করা ছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই। নতুন বাজার ও পণ্য চালু করার পাশাপাশি দেশি ও বিদেশি কোম্পানির তালিকাভুক্তির বিষয়ে বিভাগের পরিকল্পনার বিষয়ে কমিটি স্পষ্ট কোনো ধারণা পায়নি। তার ওপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক পণ্য ও বাজার উন্নয়নের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রেখেছে সেটি দৃশ্যমান নয়। এ অবস্থায় কমিটি ডিএসইর বিদ্যমান জনবল তাদের দায়িত্ব অনুসারে এক্সচেঞ্জটিতে কী অবদান রাখছে, সেটি বিশেষ নিরীক্ষা করার সুপারিশ করেছে।

এক্সচেঞ্জটির সব কর্মীর নিয়োগ প্রক্রিয়া যাচাই, নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রভাবশালীদের সম্পর্ক রয়েছে কি না, তা যাচাই করার সুপারিশ করেছে মূল্যায়ন কমিটি। একটি সেন্ট্রাল সিনিয়রিটি রোলের মাধ্যমে কর্মীদের জ্যেষ্ঠতা, পদায়ন, পদোন্নতি ও পেশাগত উন্নয়নের বিষয়টি নির্ধারণ করা যেতে পারে বলে মত দেওয়া হয়েছে। ডিএসইর মতিঝিলের কার্যালয় যথ দ্রুত সম্ভব বন্ধ করে দিয়ে এটি ব্যাংক কিংবা অন্যান্য সংস্থার কাছে ভাড়া দিতে হবে।