শেখর দত্ত: ‘আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগ’, ‘আপন ঘরে যার শত্রু তার শত্রুতা করার জন্য বাইরের কারো প্রয়োজন নেই’ প্রভৃতি কথা জাতীয় কিংবা উপজেলা নির্বাচন এলেই কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা বলে থাকেন। বিরোধী দলে থাকলে কম বলেন এবং সরকারি দলে থাকলে বলার ঘনত্ব বেড়ে যায়। বিএনপি-জামায়াত আমলে নির্বাচন সামনে রেখে ১ জানুয়ারি ২০০৫ তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের শত্রু বিএনপি কিংবা জামায়াত নয়, আওয়ামী লীগের মূল শত্রু হচ্ছে আওয়ামী লীগার।’

রও পড়ুন…

টিকটক লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি করেছে ! 

আওয়ামী লীগই যে আওয়ামী লীগের শত্রু এই কথাটা ২০১৯ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে বছর দুয়েক আগে থেকেই উত্থাপিত হতে থাকে। ২০১৮ জুন মাসের দিকে গণভবনে অনুষ্ঠিত বিশেষ বর্ধিত সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তৃণমূলের নেতারা এই কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা ওই দিনগুলোতে প্রায় প্রতিটি দলীয় সভায়ই এই কথাগুলো উচ্চারণ করতেন। নির্বাচনের পর আর ওই কথাগুলো উচ্চারিত হয় না।

আওয়ামী লীগের শত্রু তথা বিদ্রোহী হয়ে যারা নির্বাচনে লড়াই করে, তারা নির্বাচনে জিতলে আওয়ামী লীগ হয়ে যায়। আর যারা হারে তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ কখনও হয় আবার কখনও হবে-হচ্ছে করে থেমে যায়। এমনও শোনা যায়, বহিষ্কৃতরা আবার নানাভাবে বহাল তবিয়তে দলে ফিরেও আসে। বিশাল দল আওয়ামী লীগ, তাই কোথায় কী হচ্ছে, তার খোঁজ-খবর রাখাও কষ্টকর বৈকি! নির্বাচনের পর ‘জিরো টলারেন্স’ হুঁশিয়ারির মধ্যে এখনও পর্যন্ত অন্ধকার জগতের অনৈতিক-অবৈধ কাজ কিংবা করোনার সময়ে দুর্নীতির কারণে দলের অনেকেই বহিষ্কার করা হয়েছে। তাই দলের ভেতরেই আছে দলের শত্রু কথাটা এখন বলা না হলেও সঙ্গত কারণেই ‘কাউয়া’, ‘বহিরাগত’ প্রভৃতি শব্দ এবং হুমকি-ধামকি হয়ে গেছে সাংগঠনিক দিক থেকে প্রচারের একমাত্র বিষয়।

ধারণা করি, আবারও নির্বাচন সামনে এলে দলের মধ্যে যে বিভীষণ রয়েছে, এ কথাটা প্রচারে আসবে এবং আবারও বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়াবে, বহিষ্কারের কথা উঠবে, বহিষ্কার কিছু হবে, আবার হবেও না, বহিষ্কার হয়ে আবার কেউ কেউ হয়তাবা দলে ফিরেও আসবে। আরও বলা যায়, রাষ্ট্র-রাজনীতি-সমাজের ক্ষমতাবান-অর্থবান মানুষদের যে প্রতাপ, তাতে অনৈতিক-অবৈধ-দুর্নীতির কাজও চলতে থাকবে এবং বহিষ্কারও হবে, জিরো টলারেন্স যদি সত্যিকার অর্থেই ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কার্যকর হতে থাকে, তবেও বাস্তবতার কারণে ঘুরে ফিরে আবারও আসতে থাকবে এবং কমবেশি একই ধরনের ঘটনা ঘটবে। প্রশ্নটা হচ্ছে উল্লিখিত দুই গোলকধাঁধা থেকে যথাসম্ভব বের হয়ে আসার পথ কী? কীভাবে যথাসাধ্য পদানত করে রাখা যায় অনৈতিক-অবৈধ-দুর্নীতির কাজ?

এ কথা অনস্বীকার্য যে, শত্রু রয়েছে দুই রূপে। একটা দেখা যায় কিন্তু অপরটা দেখা যায় না। দলীয় ব্যক্তি যখন কোনো বিশেষ ইস্যুতে দলের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা স্বচক্ষে দেখা যায়। কিন্তু শত্রু যখন হয় আদর্শগত, তখন তা দেখা যায় না, ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। করোনাভাইরাসের মতো তখন তা নীরব ঘাতক হয়ে দাঁড়ায়। একটু ভেবে দেখলেই এটা প্রতীয়মান হবে, আদর্শগত শত্রু হচ্ছে কারণ (কজ) আর ব্যক্তিশত্রু হচ্ছে ফলাফল বা প্রভাব (অ্যাফেক্ট)।

উদাহরণ দিতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, ১৯৯৬-০১ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার পর গণভবণে তৃণমূলের নেতাদের দু-তিনটি সভা ও সম্মেলনে যোগ দেয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সেখানে গিয়ে বক্তৃতার ফাঁকে মনের তাড়নায় একেবারে মলিন ড্রেস পরা নেতাদের সাথে আমি কথা বলেছি। তারা কমবেশি সবাই বলেছে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য দলে আছি, কাজ করি। দলাদলি তারা অপছন্দ করে, কিন্তু কিছু করতে পারে না।

একবার একজন তো ক্ষমতাবানদের দাপটের কথা বলতে গিয়ে কেঁদেই দিয়েছিলেন। আরেকজন বলেছিলেন, দল করে নির্যাতিত হয়েছি, সম্পত্তি সব শেষ করেছি। এখন ছেলে বড় হয়েছে, চাকরি খুঁজছে, এমপিকে বলেছি, যদি হয়। তারপর করুণ হেসে চাকরির জন্য কী করতে হয় তা নিয়ে যা বলেছিল, তা আর নাইবা বললাম। এসব কথা পত্রিকার কলামে তখনও লিখেছিলাম। এখনও খোঁজ নিয়ে জানি, আদর্শের জন্য দলে কাজ করে এমন নেতাকর্মীর সংখ্যাই আওয়ামী লীগে বেশি, অগণিত। বলাই বাহুল্য, যিনি আদর্শের জন্য দল করেন, তিনি পদ পেলে কাজ ভালো হবে বলে মনে করেন, তবে পদলোভী হন না, পদের ধান্ধায় ঘোরেন না। তাই দল ক্ষমতায় এলে দাপট-দখল সংস্কৃতির কারণে তারা যায় পিছিয়ে। কেননা তখন কবির ভাষায়, ‘পরিমল লোভে অলি আসিয়া জুটিল’-এর মতো অবস্থা হয়।

প্রসঙ্গত বলতেই হয়, পঞ্চাশের দশকে চুয়ান্নর নির্বাচনে বিজয়ের পর রাজনীতির মধ্যমণি উদীয়মান তরুণ নেতা দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হয়েছিলেন। দলে নিয়ম ছিল মন্ত্রী হলে দলীয় পদে থাকা যাবে না। শেখ মুজিব মন্ত্রিত্ব ছেড়েছিলেন দলের প্রয়োজনে, কেননা তখন মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দল ভাঙনের দিকে যাচ্ছিল। ব্যক্তির চাইতে দল বড়, দলের চাইতে দেশ বড়, এটাই তো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা। আমাদের দেশের রাজনীতির পূর্ব প্রজন্মের নেতারা তাদের জীবন ও কর্ম থেকে এমন শিক্ষাই আমাদের জন্য রেখে গেছেন। করোনা দুর্যোগের আগে বিএনপির এক সমর্থকের সাথে দলটি কেন আন্দোলন করতে পারে না নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, দল করতে এসে নিজের পকেট গুছিয়েছে নেতারা, ভালোই তো আছেন তারা, আন্দোলনে নেমে রিক্স নেবে কেন? বাস্তবেই দল-দেশ-দশের জন্য নিজের দিকে না চেয়ে কিছু করাটা আসে আদর্শ থেকে। আদর্শটাই বড়।

একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দলের বৈশিষ্ট নির্ণয়ে ‘আদর্শবাদী দল’, ‘বুর্জোয়া দল’, ‘পেটি বুর্জোয়া দল’ প্রভৃতি কথা খুবই প্রচলিত। সাধারণভাবে বাম-কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগের কোনো আদর্শ আছে বলেই মনে করে না। প্রশ্নটা হলো যদি তাই হয়, তবে জাতীয় চার মূলনীতি কী? ওটাই তো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, জাতির জন্মলগ্নের আদর্শ। পরস্পর সম্পর্কিত ওই চার আদর্শ জাতি হিসেবে আমরা কেবল বই পড়ে পাই নাই। ওই আদর্শ দেশজ; শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনগণের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা, লড়াই-সংগ্রাম থেকে এর সৃষ্টি; বাঙালি জাতি ও মানবজাতির সব সুকৃতি-অর্জন-সাফল্য হচ্ছে এই আদর্শের আধার। এইদিক বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, জাতি ও জাতির পিতার আদর্শই আওয়ামী লীগের আদর্শ।

প্রকৃত বিচারে আওয়ামী লীগ নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘জনগণের সেবক’ উপদেশ এবং ‘জিরো টলারেন্স’ হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করে এই আদর্শের বিপরীত আদর্শ আওয়ামী লীগে বেশ মজবুত আসন গেড়ে বসেছে বলেই দলের শত্রু দল দলেই দাঁড়াচ্ছে; ‘কাউয়া’ বা ‘ বহিরাগতরা’ এসে দ্রুতই দলে ভালো জায়গা করে নিতে পারছে, দলের ভেতরেই ফ্যাক্রেনস্টাইন দাঁড়াচ্ছে। দলের অর্জনকে বিসর্জনে পর্যবসিত করছে।

প্রসঙ্গত, জাতীয়তাবাদ মূলনীতিটি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে যুক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ যদি ভুলে যাই, তবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। মৃত্যুর আগে কালেমা পড়ার পর তিনি ‘জয় বাংলা’ বলবেন বলে প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। একইভাবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি তথা সমাজতন্ত্র যদি কেউ মনেপ্রাণে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ না করে, তবে সে আওয়ামী লীগ দলের পদাধিকারী দূরে থাক, সদস্য বা কর্মী হতে পারে না।

বলাই বাহুল্য, এই আদর্শগত চর্চাটাই আওয়ামী লীগে কমে গেছে। তাই আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একপক্ষ আরেকপক্ষকে ঘায়েল করতে কিংবা নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে ‘কাউয়াদের’ আওয়ামী লীগে বিনা বাধায় রাজার হালে প্রবেশ করতে দিচ্ছে। দলে ভেতরে যখন শত্রু দাঁড়ায়, তার পরিণতি কী হতে পারে, তা বোধকরি আওয়ামী লীগের চাইতে কেউ অনুধাবন করতে পারবে না।

খুনি মোশতাক-গংরা তো ছিল আওয়ামী লীগের ভেতরে আওয়ামী লীগেরই শত্রু। আগ্রহোউদ্দীপক ব্যাপার হলো, ১৯৫৪ সালে মোশতাক যুক্তফ্রন্টের নমিনেশন পায় নাই। পরে সোহরাওয়ার্দী তাকে জিতিয়ে এনেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকা-পাকিস্তান দূতালি করেও ওই ঘাতক বেঁচে গেছে। ১৯৭৩-এর নির্বাচনে হারার পরও গায়ের জোরে জিতে এসেছে। দলের নামাবলি গায়ে দিয়ে ভেক সেজেছে। এমন মানুষ খুনি হবে না তো কে হবে?

তাই দলে আদর্শগত চর্চার মাধ্যমে ‘শত্রু’ বা ‘কাউয়া’-দের দলীয় নেতাকর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা এখন সময়ের দাবি এবং তা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগে বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা থেকেই একদল বাকশাল কায়েমের পর জেলা গভর্নরদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কোর্স করিয়েছিলেন। জেলা সম্পাদকদের প্রশিক্ষণ কোর্স করারও পরিকল্পনা ছিল। অর্থাৎ আদর্শগত প্রশিক্ষণের ওপর তিনি জোর দিয়েছিলেন।

বলাই বাহুল্য কোনো নেতাকর্মী যদি দেশের ইতিহাস না জানে, দেশ স্বাধীন করতে আমাদের পূর্বপুরুষদের কতটা ত্যাগ করতে হয়েছে তার গভীরে গিয়ে না বুঝে, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা যে জাতীয় চার আদর্শ বাস্তবায়নের করতে গিয়েই প্রাণ দিয়েছেন তা যদি উপলব্ধিতে না নেয়, তবে নতুন সময়ের উপযোগী ত্যাগ স্বীকার তারা করতে যাবেন কেন? গড্ডালিকায় তো গা ভাসাবেনই।

তাই এখন সময় এসেছে, জিরো টলারেন্স কার্যকরী করে দলে শুদ্ধি অভিযান চালানোর সাথে সাথে আদর্শগত চর্চা বাড়ানোর। কবি বলেন, ‘সুন্দর বাইরেটা অগোছালো ঘরে হারিয়ে যায়।’ এখন কিন্তু বাইরেটাও করোনা আক্রান্ত, বেশ সংকটাপন্ন। তাই জরুরিভাবে ঘরটা গোছানোর সময় এখনই আওয়ামী লীগের।