তৌফিক ইসলাম ও মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আবারো দুর্বল কোম্পানিগুলো ঘিরে কারসাজি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যেখানে ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানিগুলোর শেয়ার তলানিতে পড়ে রয়েছে সেখানে বীমা খাতের দুর্বল কোম্পানিগুলোর শেয়ার নিয়ে কারসাজি চক্র মেতে উঠছে। দুর্বল বীমা খাতের শেয়ার নিয়ে মেতে উঠেছে এক শ্রেণীর অতি মুনাফালোভী বিনিয়োগকারীরা।

এসব কারসাজি চক্র থেকে দূরে থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে সচেতন হওয়া জরুরি বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। বাজারে গুজব রয়েছে, কারসাজি চক্রের মুল হোতা চার সিন্ডিকেট চক্র মিলে এ শেয়ার নিয়ে কারসাজিতে মেতে উঠছেন। বিষয়টি তদন্ত করলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে।

রও পড়ুন…

মেঘনা পেট্রোলিয়ামের সাথে ব্যবসা বাড়াতে জেএমআই’র চুক্তি

এর আগেও এ সিন্ডিকেট চক্রটি বিভিন্ন শেয়ার নিয়ে কারসাজিতে জড়িত ছিলেন। তবে বীমা খাতের শেয়ারের পাশাপাশি অন্যান্য খাতে শেয়ার দর বাড়লে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তদন্ত কমিটি গঠন করলেও বীমা খাতের বিষয় নিরব আচরন নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু বীমা খাতের শেয়ার দর ২ মাসের অধিক সময়ের ব্যবধানে ২৩৫ শতাংশ শেয়ারের দর বাড়ছে।

এদিকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নজরদারিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমা খাতের ছয় কোম্পানি। তালিকাভুক্ত ছয় কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি ও ইনসাইডার ট্রেডিং অভিযোগ নড়েচড়ে বসছে বিএসইসি। বীমা খাতের কোম্পানিগুলো ঘিরে সক্রিয় রয়েছে কারসাজি চক্ররা। এর জের ধরে এ কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর কোন কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। আর গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে এ কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বাড়ানো হচ্ছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

কোম্পানিগুলো হলো: প্যারামাউন্ড ইন্সুরেন্স, ইস্টার্ন ইন্সুরেন্স, প্রভাতী ইন্সুরেন্স, নিটল ইন্সুরেন্স, পিপলস ইন্সুরেন্স, এশিয়া ইন্সুরেন্স। সাম্প্রতিক সময়ে এসব কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বিএসইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এর আগে শেয়ার দরে অস্বাভাবিক উল্লম্ফনের পেছনে কারসাজি বা বিধি বহির্ভুতভাবে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ হয়েছে কিনা জানতে চেয়ে কোম্পানিগুলোকে বেশ কয়েক বার শোকজ করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। কিন্তু কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে দর বাড়ার পেছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষরা।

প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড শেয়ার দরে অস্বাভাবিক উল্লম্ফনের পেছনে কারসাজি বা বিধি বহির্ভুতভাবে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ হয়েছে কিনা জানতে চেয়ে গত ২০ আগষ্ট শোকজ করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। তারই প্রেক্ষিতে দর বাড়ার কোন মূল্যসংবেদনশীল তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন কোম্পানিগুলোর কর্তৃপক্ষ।

কোম্পানিগুলোর বিষয়ে বিএসইসি’র সার্ভিলেন্স বিভাগের এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যেহেতু কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে কোন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ হয়নি তাই এখানে অন্য কোন পক্ষ থেকে কারসাজি হয়েছে কিনা আমরা খতিয়ে দেখবো। কারসাজির ঘটনা ঘটে থাকলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর প্রায় ২২০ শতাংশ দর বেড়েছে। এদিকে পুঁজিবাজারে লেনদেন স্বাভাবিক হতেই কারসাজির সঙ্গে জড়িতরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। লোকসানী প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সকে ঘিরেই চলছে কারসাজি। সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানিটি ৪ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল। শুধু তাই নয় প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটি লোকসান করেছে। তবুও গত ৩ মাসের ব্যবধানে শেয়ারটির দও ৪০ টাকা থেকে লাফিয়ে বাড়তে বাড়তে ১২৮ টাকায় উঠলে ও রোববার শেয়ারটির দও দাঁড়ায় ১০৮.৩০ টাকা।

ডিএসইর ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, জানুয়ারি-মার্চ প্রথম প্রান্তিকে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের লোকসান দাঁড়িয়েছে ১৪ পয়সা। গত বছরের এই সময়ে শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৩৬ পয়সা। সর্বশেষ অর্থবছরে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ২ শতাংশ বোনাস ও ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোম্পানিটির দর ছিল ১৮.৪০ টাকা। পরবর্তীতে দর ওঠানামার মধ্যে রোববার শেয়ারটির সর্বোচ্চ ১১৪ টাকায় উঠলেও দিনশেষে ১১১ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর আগেও বেশ কিছু বিমা কোম্পানির দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে দেখা গেছে। এসব দুর্বল বীমা কোম্পানি কিন্তু কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের একই ধারা দেখা গেছে। বিনিয়োগকারীদের শেষ পর্যন্ত পস্তাতে হবে। কারণ কোম্পানির আয় ও লভ্যাংশ কোনভাবেই এভাবে দরবৃদ্ধিকে সমর্থন করে না।

ইস্টার্ন ইন্সুরেন্স: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর প্রায় ২৩৫ শতাংশ দর বেড়েছে। ইস্টার্ন ইন্সুরেন্সের শেয়ারদর নিয়ে কারসাজিতে মেতেছে একটি সিন্ডিকেট চক্র। এ কোম্পানির টানা বৃদ্ধি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের নিয়ন্ত্রক কার হাতে। তাছাড়া গত ২ মাসের ব্যবধানে ২৯.৮০ টাকায় শেয়ার এখন ১০০ টাকা। আলাদিনের চেরাগের মত শেয়ার দর হু হু করে বাড়ছে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ারদর সবোর্চ্চ দরে অবস্থান করছে।

প্রভাতী ইন্সুরেন্স: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর প্রায় ১৬৬ শতাংশ দর বেড়েছে। গত ২ মাসের মাথায় প্রভাতী ইন্সুরেন্সের শেয়ারের দর দ্বিগুন বেশি হয়েছে। গত ২ জুলাই শেয়ারের দর ছিল ১৯.৫০ টাকা, ২০ সেপ্টেম্বও এ শেয়ারের দর ৫২ টাকা। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন বীমা খাতের প্রভাতী ইন্সুরেন্সে এমন কি ঘটনা ঘটলো যে শেয়ারের দর ˜িগুন বেশি হয়েছে। এ শেয়ারের কারসাজিতে কোম্পানির লোকজন ও সিন্ডিকেট চক্র জড়িত রয়েছে। শীর্ষ কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউজ থেকে এ শেয়ারের ইনসাইডার ট্রেডিং’র অভিযোগ রয়েছে।

নিটল ইন্সুরেন্স: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নিটল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর প্রায় ১৫৪ শতাংশ দর বেড়েছে। গত ৭ জুলাই কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ২১.৮০ টাকায়। টানা দর বেড়ে ২০ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার দর পৌঁছায় ৫৫. ৪০ টাকায়। অর্থাৎ দুই মাসের ব্যবধানে কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে প্রায় ১৫৪ শতাংশ। সম্প্রতি এর দর বাড়ার কারণ জানাতে কোম্পানিটিকে নোটিশ পাঠায় ডিএসই। কিন্তু নোটিশের জবাবে ১২ ডিসেম্বর কোম্পানিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এজন্য তাদের কাছে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।

পিপলস ইন্সুরেন্স: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত পিপলস ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর প্রায় ১৪২ শতাংশ বেড়েছে। গত ২২ জুন কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ১৫.৪০ টাকায়। টানা দর বেড়ে ২০ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার দর পৌঁছায় ৩৭.৪০ টাকায়। অর্থাৎ দুই মাসের ব্যবধানে কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে প্রায় ১৪২ শতাংশ। সম্প্রতি এর দর বাড়ার কারণ জানাতে কোম্পানিটিকে নোটিশ পাঠায় ডিএসই। কিন্তু নোটিশের জবাবে ১২ ডিসেম্বর কোম্পানিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এজন্য তাদের কাছে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।

এশিয়া ইন্সুরেন্স: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর প্রায় ১২৯ শতাংশ বেড়েছে। গত ২ জুলাই কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ১৭ টাকায়। টানা দর বেড়ে ২০ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার দর পৌঁছায় ৩৯ টাকায়। অর্থাৎ দুই মাসের ব্যবধানে কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে প্রায় ১২৯ শতাংশ।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, পুঁজিবাজারে লেনদেনের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর বাড়বে আবার কমবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোন রকম কারণ ছাড়াই কোন কোম্পানির শেয়ার দর হঠাৎ করে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়াটার মানে অন্য কিছু বুঝায়। নিশ্চয় এ কোম্পানিটিতে কারসাজি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এ কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের ক্ষেত্রে এখনি সাবধান থাকতে হবে। নয়তো নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে শর্তে বলেন, বীমা খাতের কোম্পানিগুলো নিয়ে কারসাজি চলছে। অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম অবমূল্যায়িত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কর্তৃপক্ষের উচিত বীমা খাতের এসব কোম্পানির বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া।