মেসবাহ উদ্দিন খান (মিঠু):  সম্প্রতি দেশের পুঁজিবাজারের লেনদেন ও মূল্য সূচকের বৃদ্ধি পাওয়া এবং এর ধারাবাহিকতায় বাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক প্রকার উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। বিনিয়োগকারীরা এখন বিভিন্ন ব্রোকার হাউসে, বিভিন্ন পোর্টফোলিও ম্যানেজারের সাথে কথা বলছে এবং তারা তাদের বিনিয়োগের ব্যাপারে বিভিন্ন প্রকার পরামর্শ চাচ্ছে। তাদের আগ্রহ মূলত সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগে কিন্তু বাজারের বর্তমানে ঝুঁকি এবং তাদের অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতার কারনে বাজারে তারা অনুপ্রবেশ করতে কিছুটা দ্বিধান্বিত।

সমস্যাঃ সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগের জন্য অনেকে আগ্রহী হলেও প্রকৃত জ্ঞান এবং মার্কেট সম্বন্ধে সম্যক ধারণা না থাকার কারণে স্বাচ্ছন্দে বিনিয়োগ করতে পারছেন না এবং বিনিয়োগের ঝুঁকি এবং বিনিয়োগের বিভিন্ন মাধ্যম সম্বন্ধে তারা সম্পূর্ণভাবে অবহিত নয় । ফলে পরবর্তীতে বিভিন্ন মার্কেটের প্রোডাক্ট সম্বন্ধে তারা ওয়াকিবহাল নয়। শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগকারীগন সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ করাটাকে পছন্দসই মনে করেন ।

সেকেন্ডারি মার্কেটে স্টকের পাশাপাশি যে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা যায় এবং মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ যে অধিক লাভজনক এবং অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ তা অনেক সময় বিনিয়োগকারীদের অজ্ঞাতই থেকে যায় । তাদেরই অনাগ্রহের কারণে আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত মিউচুয়াল ফান্ড সমূহ এখনো পর্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি।

মিউচুয়াল ফান্ডের প্রকারঃ প্রথমত আমরা জেনে নেই বাজারে কি কি ধরনের মিউচুয়াল ফান্ড আছে এবং এর প্রকৃতি এবং সংজ্ঞা। মিউচুয়াল ফান্ড মূলত দুই প্রকার একটি হচ্ছে ওপেনএন্ড মিউচুয়াল ফান্ড এবং অপরটি ক্লোজএন্ড মিউচুয়াল ফান্ড।

ওপেনএন্ড মিউচুয়াল ফান্ড বলতে আমরা সেই সমস্ত মিউচুয়াল ফান্ড গুলিকে বুঝি, যার নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ উল্লেখিত থাকে না এবং বিনিয়োগকারীগণ নিজের ইচ্ছামত সময় ও আকার বিবেচনা করে বিনিয়োগ করতে পারেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে পারেন। সে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার সর্বত স্বাধীনতা রয়েছে। এবং ক্লোজএন্ড মিউচুয়াল ফান্ড বা মেয়াদী মিউচুয়াল ফান্ড বলতে আমরা সেই সমস্ত মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোকে বুঝি যা শুধুমাত্র মেয়াদান্তে ভাঙ্গাতে হবে ।

ওপেন এন্ড মিউচুয়াল ফান্ডগুলি সাধারণত ছোট পরিসরে হয়ে থাকে এবং পুঁজিবাজারে তাদের নিবন্ধিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই পক্ষান্তরে ক্লোজএন্ড মিউচুয়াল ফান্ডগুলি পুঁজিবাজারে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধিত হতে হবে এবং এর ফান্ডসাইজ সাধারণত বৃহৎ পরিসরে হয়ে থাকে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটঃ মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে আজকের লেখার কারণটা একটু ব্যাখ্যা করতে চাই । আমরা কেন মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করব বা কেন এই মুহূর্তে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করাটা প্রফিটেবল বলে আমরা মনে করছি ! আমরা বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিআকর্ষণ করে বলতে চাচ্ছি যদি তারা এই মুহূর্তে স্টকে বিনিয়োগের পাশাপাশি মেয়াদী বা বেমেয়াদী মিউচুয়াল ফান্ড গুলিতে বিনিয়োগ করে তবে বাজারের মৌলিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ স্টক মার্কেটে বিনিয়োগের তুলনায় অধিকতর লাভজনক হবে বলে আমরা আশাবাদী।

প্রচলিত বিনিয়োগ ধারনাঃ হাউজহোল্ড ডিপোজিট এর একটা বড় অংশই বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে এফডিআর অথবা মেয়াদী বিনিয়োগ হিসেবে বিনিয়োগ করে থাকে । বর্তমানে সরকার কর্তৃক রেট নির্দিষ্ট করে দেয়ার ফলে ব্যাংকগুলি নির্দিষ্ট হারে মুনাফা প্রদান করছে যা অত্যন্ত কম এবং মুনাফার উপর শতকরা ১০% কর আরোপ করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে বিনিয়োগকারীগণ তাদের আশানুরূপ রিটার্ন পাচ্ছেন না। সম্প্রতি দেশে রেমিটেন্সে চমৎকার প্রবৃদ্ধি পেয়েছে এবং ব্যাংকগুলিতে তারল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে আশানুরূপ রিটার্ন দিতে এবং সঞ্চয়পত্রের সীমা ও সীমাবদ্ধতার কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীগণ সর্বোচ্চ মুনাফা লাভে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের বিকল্প প্রস্তাবনা হিসাবে ওপেন মিউচুয়াল ফান্ড গুলিতে বিনিয়োগ করাটা তুলনামূলকভাবে লাভজনক হবে বলে আমরা আশা করছি।

পেশাদারি ও দক্ষ পরিচালনাঃ মিউচুয়াল ফান্ড সমূহ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রফেশনাল এবং অভিজ্ঞতার নিরিখে পরিচালিত হয়ে থাকে । সর্বোচ্চ পেশাদারি মনোভাব নিয়েই মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালিত হয়ে থাকে । সুতরাং সেকেন্ডারি মার্কেটে তাঁদের বিনিয়োগ স্ট্রাটেজী সাধারণত অন্যদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে সময় উপযোগী এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাঃ ওয়ালটন হাইটেক পার্ক নিবন্ধিত হওয়ার পরে এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বাজারে উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক কোম্পানি বুক বিল্ডিং এর মাধ্যমে প্রাইস ডিসকভারির জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে । তার মধ্যে অন্যতম হলো এনার্জিপ্যাক আমরা জানি এনার্জিপ্যাকের মূল্য নির্ধারিত হয়েছে পঁয়ত্রিশ টাকা এবং পরবর্তীতে মীর আখতার এবং আরও একটা বড় আইপিও আসছে রবি অজিয়াটা।

এ ছাড়াও ফিক্সডপ্রাইস মেথডে অনেকগুলি কোম্পানি আইপিও তে আসার জন্যে প্রক্রিয়াধীন আছে । এটা বলা যায় যে আগামী কয়েক মাস আইপিও বা প্রাইমারী মার্কেটে নতুন কোম্পানি আসার ধারাবাহিকতা বাজায় থাকবে। প্রাইমারি মার্কেটে সাধারন বিনিয়োগকারীগণ শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট লটের শেয়ার কেনার জন্য এণ্টাইটেল হয়ে থাকেন । কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ড অপারেটরদের জন্য বরাদ্ধ থাকে আইপিও কোটা- কোটা বরাদ্দ থাকায় সেখানে শেয়ার পাওয়ার সক্ষমতা অনেক বেশি এবং নিঃসন্দেহ মুনাফারও।

মূল্য নির্ধারণঃ শুধুমাত্র ওয়ালটনের নিবন্ধনের কারণে কোন কোন ওপেনএন্ড মিউচুয়াল ফান্ডের ব্যবস্থাপকের আজ অবধি এনএভি বেড়েছে প্রায় ৫ পার্সেন্টের মতো । শুধুমাত্র একটি আইপিওতে যদি ৫ শতাংশের অধিক রিটার্ন চলে আসে, তাহলে পরবর্তীতে যে সমস্ত কোম্পানি সমূহ বাজারে আসবে তার ব্যাপারে আমরা সহজেই আশাবাদী হতে পারি। আমাদের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য এটাই যে ভবিষ্যতে ওপেনএন্ড মিউচুয়াল ফান্ডের যে এনএভি নির্ধারিত হতে যাচ্ছে তা নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশা করা যায়।

দেশে বর্তমানে ৪৭টি সম্পদ ব্যাবস্থাপনা কম্পানির ৫৮টি ওপেনএন্ড মিউচুয়াল ফান্ডের ও ৩৭ টি ক্লোজএন্ড মিউচুয়াল ফান্ডের পরিচালনা করে আসছে। ওপেনএন্ড মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের (AUM) পরিমাণ চার হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং ক্লোজএন্ড মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের (AUM) পরিমাণ ৫ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা । মিউচুয়াল ফান্ডগুলিকে মাসিক, ষান্মাসিক এবং সাপ্তাহিক আনিং ও এনএভি ডিক্লেয়ার করা এবং ত্রয়মাসিক পোর্টফলিও যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পাবলিকলি সম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত যে সম্পদ ব্যবস্থাপনা অংশীদার ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান গুলি আছে তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে এই তথ্য সরবরাহ করার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে ।

ফলে একজন বিনিয়োগকারী সহজেই তার বিনিয়োগের বর্তমান মূল্য কত তা জানতে পারে । এবং সে তার বিনিয়োগের অবস্থা সম্বন্ধে অবগত হতে পারে । আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে মিউচুয়াল ফান্ড গুলিকে তাদের টোটাল অ্যাসেটের ৬০ পার্সেন্ট মার্কেটে বিনিয়োগ করতে হবে ও মুনাফার ৭০ শতাংশ বণ্টন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে । এই বাধ্যবাধকতার কারণে উত্তোলিত মিউচুয়াল ফান্ডের টাকা পারতপক্ষে দেশের সেকেন্ডারি বাজার সুসংহত করে । যত বেশি মিউচুয়াল ফান্ড মার্কেটে নিবন্ধিত হবে সেকেন্ডারি মার্কেটে ভালো শেয়ারের বিনিয়োগের মাত্রা ততবেশি বৃদ্ধি পাবে।

উপসংহারঃ
উপরের ব্যাখ্যার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, ওপেনএন্ড মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ স্বল্প সময়ে তাদের পার্সেন্টেজ অফ গেইন যেকোনো বিনিয়োগের তুলনায় অনেক বেশি হবে। এই কারণে আমরা বলতে চাচ্ছি যারা যারা বিভিন্ন ব্যাংকে বা ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনে মেয়াদী বিনিয়োগ করে থাকেন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী সময়ের জন্য, তাদের জন্য এটা অল্টারনেটিভ বা বিকল্প বিনিয়োগের প্রস্তাবনা হতে পারে । আমি মনে করি আগামীতে সচেতন বিনিয়োগকারীগন বিকল্প বিনিয়োগের প্রস্তাব গ্রহণ করবে এবং এর মাধ্যমে তারা অধিক লাভবান হতে পারবেন যা হবে অনেকটুকু নিশ্চিত ও কম ঝুঁকিপূর্ণ।

মেসবাহ উদ্দিন খান (মিঠু), প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), শেলটেক ব্রোকারেজ লিমিটেড।