দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশে লুব্রিকেন্টস অয়েলে একচেটিয়া প্রাধান্য রয়েছে বহুজাতিক ব্র্যান্ডগুলোর। দেশীয় বেশ কিছু কোম্পানি লুব্রিকেন্ট অয়েল ব্লেন্ডিং করে মবিল, টোটাল, বিপি, ক্যাস্ট্রলসহ বিভিন্ন বহুজাতিক ব্র্যান্ড নামে পণ্য বিক্রি করছে। তবে বহুজাতিকের ভিড়ে দেশীয় কোম্পানিও লুব্রিকেন্টস অয়েলের ব্যবসায় আকর্ষণীয় অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে দেশীয় সেরা ব্র্যান্ড হচ্ছে ‘বিএনও’ লুব্রিকেন্টস, যা উৎপাদন করছে লুব-রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেড। বর্তমানে দেশে লুব্রিকেন্টস অয়েল ব্যবসায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বিএনও।

রও পড়ুন..

পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিশেষ তহবিলে ৯ মাসে বিনিয়োগ ২৬.৫ শতাংশ

ব্যবসা সম্প্রসারণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা সম্পন্ন হলে দেশে লুব্রিকেন্টস অয়েলে শীর্ষে আসবে বলে জানিয়েছেন লুব-রেফের কর্মকর্তারা। শুধু তা-ই নয়, লুব্রিকেন্টস অয়েল ব্যবহৃত কাঁচামাল ‘বেইজ অয়েল’ উৎপাদনেরও উদ্যোগ নিয়েছে কোম্পানিটি। দেশে মোট চাহিদার প্রায় অর্ধেক বেইজ অয়েল উৎপাদনে কর্ণফুলী নদীর তীরে নিজস্ব জমিতে প্রকল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে কোম্পানিটি।

ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে লুব-রেফ বাংলাদেশ। ইতিমধ্যেই কোম্পানিটি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) থেকে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারের প্রান্ত-সীমা মূল্য (কাট-অফ প্রাইস) নির্ধারণে নিলামের অনুমতি পেয়েছে। বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে কোম্পানিটি ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে, যার মধ্যে বিদ্যমান সম্প্রসারণে ৯৮ কোটি টাকা ব্যয় করবে। কারখানা সম্প্রসারণ সম্পন্ন হলে লুব-রেফের উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ হবে।

বর্তমানে দেশে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টন লুব্রিকেন্টস অয়েলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে লুব-রেফের উৎপাদন সক্ষমতা হচ্ছে প্রায় ১৭ হাজার টন। কারখানা সম্প্রসারণের পর উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে প্রায় ৩৪ হাজার টনে। অর্থাৎ মোট চাহিদার প্রায় ২১ শতাংশের উৎপাদন সক্ষমতা থাকবে বলে লুব-রেফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন। লুব্রিকেন্টসের বাজারে বর্তমানে শীর্ষে রয়েছে বহুজাতিক ব্র্যান্ড ‘মবিল’, যার স্থানীয় উৎপাদক এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেড।

এমজেএলের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলও বহুজাতিক ব্র্যান্ডের নামে লুব্রিকেন্টস ব্লেন্ডিং করছে। বহুজাতিক ব্র্যান্ড ‘বিপি’ নামে লুব্রিকেন্টস অয়েল বাজারজাত করে মেঘনা পেট্রোলিয়াম। এ ছাড়া ‘টোটাল’ ব্র্যান্ড নামে পদ্মা অয়েল ও ‘ক্যাস্ট্রল’ নামে যমুনা অয়েল লুব্রিকেন্টস অয়েল বাজারজাত করছে।

লুব-রেফ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, লুব্রিকেন্টস অয়েলে দেশীয় ও বহুজাতিক ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে ‘বিএনও’ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। আর দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে আমরা শীর্ষে। তবে কারখানা সম্প্রসারণের পর দেশীয় ও বহুজাতিক ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে আমরা প্রথম অবস্থানে আসব আশা করছি।

মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, পেট্রোকেমিক্যাল ও লুব্রিকেন্ট শিল্পে আমাদের প্রায় চার দশকের অভিজ্ঞতা রয়েছে। স্থানীয় প্ল্যান্টে বিশ^মানের লুব্রিকেন্টস প্রস্তুত করে এরই মধ্যে বাজারের আস্থা অর্জন করেছে লুব-রেফের ব্র্যান্ড বিএনও। পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তিতে অটোমোটিভ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও মেরিন লুব্রিকেটিং পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করছে এই প্রতিষ্ঠান। লুব্রিকেন্টস শিল্পে উদ্ভাবনী প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ন্যানো ও নিনাস নামের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশে এটিই প্রথম বলে দাবি করেন তিনি।

এদিকে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পরিবেশ সুরক্ষার অংশ হিসেবে ব্যবহৃত লুব্রিকেন্টস সংগ্রহ করে তা পুনরায় পরিশোধন করছে লুব-রেফ। এতে করে একদিকে যেমন লুব্রিকন্টেস বর্জ থেকে পরিবেশদূষণ কম হচ্ছে, অন্যদিকে কোম্পানিটি রি-সাইক্লিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে ভালো ব্যবসাও করছে। বর্তমানে পণ্য বিক্রি থেকে কোম্পানির যে আয় হচ্ছে তার ৬০ শতাংশই আসছে পুনরায় পরিশোধিত লুব্রিকেন্টস থেকে।

লুব-রেফের কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি ফিনল্যান্ডের একটি কোম্পানির সঙ্গে প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে ন্যানো টেকনোলজিসমৃদ্ধ লুব্রিকেটিং অয়েল সামগ্রী উৎপাদন ও বিপণন শুরু করেছে। তা ছাড়া দেশের বৈদ্যুতিক খাতে আমদানিনির্ভর ট্রান্সফরমার অয়েল প্রস্তুত ও সেন্ট্রিফিউজিংয়ের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে।

লুব্রিকেন্টস অয়েল উৎপাদনে প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে বেইজ অয়েল, যার পুরোটাই আমদানিকৃত। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বেইজ অয়েলের বিপুল চাহিদা থাকায় ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে বেইজ অয়েল রিফাইনারি প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে বছরে প্রায় ৭০ হাজার টন বেইজ অয়েল উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে লুব-রেফের।

ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা লুব-রেফের প্রধান উদ্যোক্তা মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে কর্ণফুলী নদীর তীরে একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল থিম পার্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের প্রথম বেইজ অয়েল রিফাইনারি, হাউড্রোজেন প্ল্যান্ট, বিশেষায়িত বিটুমিন প্ল্যান্ট ও এক লাখ টনের একটি ট্যাংক টার্মিনাল প্রস্তুতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কর্ণফুলী নদীতীরে কোম্পানির নিজস্ব ৩০ একর জায়গা রয়েছে। এরই মধ্যে সেখানে ট্যাংক টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ৪০০ কোটি টাকার সিন্ডিকেটেড ঋণের প্রক্রিয়া চলছে। এর বাইরে অন্যান্য প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীনা বিনিয়োগ আসবে।

লুব-রেফের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালের সমাপ্ত হিসাব বছরে কোম্পানির পণ্য বিক্রি থেকে আয় ছিল ১৫৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। এ সময়ে পরিচালন মুনাফা হয় ৩০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। আর কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয় ২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এ সময়ে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ২ টাকা ৮ পয়সা। কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পত্তি মূল্য (পুনর্মূল্যায়ন সঞ্চিতিসহ) ৩১ টাকা ৯৩ পয়সা।