দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের জন্য একের পর এক দুঃসংবাদ সিভিও পেট্টোকেমিক্যালের। কাঁচামালের অভাব ও মানহীন জ্বালানি পণ্য পরিশোধনের অভিযোগে সরকারি সিদ্ধান্তে বন্ধ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম। এর আগে করোনার প্রভাবে বিক্রি শূন্যে নামে। এতে লোকসানি কোম্পানিতে পরিণত হয় কোম্পানিটি। কবে উৎপাদন চালু হবে তারও নিশ্চয়তা নেই।

ফলে বিনিয়োগকারীরা রয়েছে চরম আতঙ্কে। সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের আদেশে পেট্টোবাংলা বেসরকারি ১২ কোম্পানিকে কনডেনসেট সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। এ ১২ কোম্পানির মধ্যে সিভিও পেট্টোকেমিক্যালও একটি। কনডেনসেট না পাওয়ায় কোম্পানিটির উৎপাদন কার্যক্রম জুলাই থেকে বন্ধ রয়েছে।

, বেসরকারি ১৪টি এবং সরকারি সাতটি কনডেনসেট ফ্র্যাকশনেশন প্লান্ট থেকে সরবরাহকৃত কনডেনসেটের বিপরীতে অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন নিত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। দেশের চাহিদার সব পেট্রোল সংগ্রহ করা হতো এই ২১ প্লান্ট থেকেই। প্রথম থেকে ৮০ মানের পেট্রোল সরবরাহ করে এলেও ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল বিএসটিআই পেট্রোলের আরওএন (রিসার্চ অকটেন নাম্বার) ৮৭ নির্ধারণ করে।

কিন্তু শুরু থেকে আরওএন ৮০-এর ওপরে নিতে পারেনি প্লান্টগুলো। কিন্তু চলতি বছরে ১৭ ফেব্রুয়ারি পেট্রোলের মান ৮৯ নির্ধারণ করে বিএসটিআই। এর আগে থেকে কনডেনসেট ফ্র্যাকশনেশন প্লান্টগুলো থেকে বিএসটিআইয়ের মান অনুযায়ী জ্বালানি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। পরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পেট্রোল উৎপাদনকারী ১২ প্লান্টকে কনডেনসেট বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সে আলোকে গত ১ জুলাই থেকে সেই ১২ প্লান্টকে কনডেনসেট বরাদ্দ বন্ধ করে দেয় বিপিসি।

এগুলো হলো সুপার রিফাইনারি লিমিটেড, অ্যাকোয়া মিনারেল টারপেনটাইন অ্যান্ড সলভেন্টস প্লান্ট লিমিটেড, পিএইচপি পেট্রো রিফাইনারি, চৌধুরী রিফাইনারি, গোল্ডেন কনডেনসেট অয়েল রিফাইনারি, জেবি রিফাইনারি, ইউনিভার্সেল রিফাইনারি, লার্ক পেট্রোলিয়াম, সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্টস, রূপসা ট্যাংক টার্মিনাল ও কার্বন হোল্ডিং লিমিটেড। অপরদিকে সুপার পেট্রোকেমিক্যাল (প্রা.) লি. ও পেট্রোম্যাক্স রিফাইনারি লিমিটেড থেকে বিএসটিআই মানের (আরওএন ৯৫) অকটেন পাওয়া যাওয়ায় এই দুই প্রতিষ্ঠানে কনডেনসেট সরবরাহ অব্যাহত রাখে বিপিসি।

সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনারি লিমিটেড সূত্রে জানা যায়, জ্বালানি খাতে নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকায় জ্বালানি মন্ত্রণালয় গত ২০১৬-১৭ অর্থবছর সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে কনডেনসেট সরবরাহ বন্ধ রাখে।

নানা দেনদরবার করে পরে চালু করলেও মূলত তখন থেকে কোম্পানিটি অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৫০ লাভ মেট্রিক টন হলেও উৎপাদন করতে পারে ১০ থেকে ১২ হাজার মেট্রিক টন। প্রতিষ্ঠানটি চাহিদানুসারে কনডেনসেট না পাওয়ায় লাভবান হতে পারছে না। অপরদিকে চলতি বছরের জুলাই থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় কনডেনসেট সরবরাহ।

এসব নিয়ে অস্থিরতায় আছে কোম্পানিটির সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। এর মধ্যে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা ব্যতীত প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের গত এক বছরের শেয়ারদর কমেছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। যদিও ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল উৎপাদনে আসে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত জ্বালানি খাতের সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনারি লিমিটেড।

প্রতিষ্ঠানটির ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক হিসাবমতে, ৩১ সেপ্টেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির টার্নওভার হয়েছিল তিন কোটি ৪৩ হাজার ৯১ হাজার টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২০ কোটি ৬৮ লাখ ১২ হাজার টাকা। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের ব্যবসা পরিচালনা করে লোকসান হয়েছে এক কোটি ৭২ লাখ টাকা, যেক্ষেত্রে আগের অর্থবছরের নিট মুনাফা ছিল ২৪ লাখ টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরেও কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। আগামী ২৪ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটি বার্ষিক সাধারণ সভা করবে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৩ জানুয়ারি সিভিও পেট্রোকেমিক্যালের প্রতিটি শেয়ারের দর ছিল ২৩৮ টাকা। আর গতকাল শেয়ারপ্রতি দাম ছিল ১১৫ টাকা ৪০ পয়সা টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি মূল্য কমেছে ১২২ টাকা ৬০ পয়সা। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিককারীদের ক্যাপিটাল লস প্রায় ৩০৯ কোটি টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বেসরকারি রিফাইনারির উদ্যোক্তা বলেন, পেট্রোবাংলার মালিকানাধীন চারটি ও ব্যক্তি খাতের ১৩টির মধ্যে ৯টি ফ্র্যাকশনেশন প্লান্টে কনডেনসেটের চাহিদা ১৩ লাখ ৭০ হাজার টন। অথচ এর বিপরীতে পেট্রোবাংলার বর্তমান কনডেনসেট উৎপাদন/সরবরাহ সক্ষমতা পাঁচ-ছয় লাখ টন। এতে কম-বেশি সবাই তাদের উৎপাদন সক্ষমতার পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছে না। আর একটি রিফাইনারি কমপক্ষে ৬০ শতাংশ ক্যাপাসিটি ব্যবহার করতে না পারলে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়। তবে এ খাতে কিছু কোম্পানি নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকায় সবাই এ ব্যবসা সংশ্লিষ্টদের দোষী ভাবে।

এ বিষয়ে জানতে সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনারি লিমিটেডের কোম্পানি সচিব খাজা মঈন উদ্দিন হোসাইন বলেন, ‘চলতি বছরটা আমাদের জন্য অনেক খারাপ যাচ্ছে। একদিকে করোনার প্রভাব ছিল, অন্যদিকে উৎপাদন বন্ধ। ফলে আমরা লোকসানে আছি। অথচ মাত্র ২৩ শতাংশ উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে আমরা মুনাফায় ছিলাম।

আর কবে উৎপাদন চালু হবে, তা সুনিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা চালুর জন্য কাজ করছি। আমাদের অ্যাসোসিয়েশনও কাজ করছে। এ খাতে ব্যাংকের অনেক টাকা বিনিয়োগ আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আসলে এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা একটু তো চিন্তিত হবে। অনেক টাকা তো ক্যাপিটাল ও ডিভিডেন্ট লস হলো। এটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।’

উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে বায়জিদ শিল্প এলাকায় চিটাগং ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রির নামে একটি ভেজিটেবল অয়েল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন মাওলানা মোহাম্মদ ইউনুস। খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি হিসেবে ১৯৯০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল।

পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠানটি ভেজিটেবল অয়েল থেকে পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনারি প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে ব্যবসায়িক ধরন পরিবর্তনের কারণে খাত পরিবর্তন করে ২০১৪ সালের এপ্রিলে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত মূলধন ১৫০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ২৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। আর মোট শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তাদের ৫০ শতাংশ এবং বাকি ৫০ শতাংশ শেয়ার সাধারণ, প্রাতিষ্ঠানিক ও বিনিয়োগকারীদের।