দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের প্রায় সাড়ে ১৪০০ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি পূরণে সাড়া নেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের। এই বিশাল অঙ্কের ঘাটতি পূরণের জন্য মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে ধরনাও দিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় খাতের চতুর্থ বৃহত্তম এই ব্যাংকটি। সর্বশেষ গত ৫ নভেম্বর আবারো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর চিঠি দিয়ে মূলধন ঘাটতি পূরণে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব পেশ করেছে রূপালী ব্যাংক।

কিন্তু তাতেও তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে গত দুই অর্থবছর ধরে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য আরো কোনো সরকারি ব্যাংককে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ বা বাজেট সহায়তা দেয়া হবে না।

এই যখন পরিস্থিতি, তখন এই ব্যাংকের পক্ষ থেকে সেই পুরনো কথা নতুন করে বলা হয়েছে যে, ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারায় ঋণপত্র (এলসি) খোলাসহ আন্তর্জাতিক ব্যবসা পরিচালনা ও সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট’ কম হওয়ায় বিভিন্ন কার্য সম্পাদনে বিদেশী ব্যাংকগুলোকে সর্বদা বেশি চার্জ দিতে হচ্ছে। ফলে দেশ-বিদেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় রূপালী ব্যাংক ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে।’

রূপালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাসেল-৩’ গাইডলাইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মূলধন (অনুমোদিত ও পরিশোধিত) সংরক্ষণে রূপালী ব্যাংক বিকল্প তিনটি প্রস্তাব দিয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাংকটির পক্ষ থেকে চলতি বছরের গত ২৯ জুলাই প্রথম আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) কাছে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু সেই চিঠির কোনো জবাব পায়নি ব্যাংকটি। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিকল্প তিনটি প্রস্তাব বিবেচনার জন্য গত ৫ নভেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’-এর সিনিয়র সচিব বরাবর পুনরায় চিঠি দেয় রূপালী ব্যাংক।

বিকল্প প্রস্তাব তিনটি হচ্ছে- এক. সরকার কর্তৃক রূপালী ব্যাংকের অনুকূলে গ্যারান্টিপত্র ইস্যু করা এবং বাংলাদেশ ব্যাংককর্তৃক ওই গ্যারান্টিকে মূলধনের মর্যাদা প্রদান। দুই. ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন বাড়াতে ২:১ অনুপাতে (১টি শেয়ারের বিপরীতে ২টি) রাইট শেয়ার ইস্যুর অনুমোদন। তিন. সরকার কর্তৃক রূপালী ব্যাংককে নগদ অর্থ বা দীর্ঘ মেয়াদি বন্ড প্রদান করা এবং প্রদত্ত নগদ অর্থ বা বন্ড নন-কিউমুলেটিভ নন-কনভার্টিবল প্রিফারেন্স শেয়ার’ ইস্যুর মাধ্যমে টিয়ার-১ ক্যাপিটাল-এ অন্তর্ভুক্ত করার অনুমতি প্রদান।

সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানায়, রূপালী ব্যাংকের মূলধন বাড়ানোর প্রস্তাবটি প্রায় আড়াই বছর ধরে ঝুলে আছে। মূলধন ঘাটতি পূরণে অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন বাড়াতে ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি অনুমোদিত মূলধন ৭০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা এবং ২:১ অনুপাতে (১টি শেয়ারের বিপরীতে ২টি) রাইট শেয়ার ছেড়ে পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ।

এ বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অনুমতির লক্ষ্যে ওই বছরই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে রূপালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়। চিঠির জবাবে ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন’ (বিএসইসি)-এর মতামত গ্রহণের জন্য রূপালী ব্যাংককে নির্দেশ দেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’। সে নির্দেশ মোতাবেক ২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি বরাবর চিঠি পাঠায় রূপালী ব্যাংক। এ বিষয়ে বিএসইসি মতামত জানালেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো কোনো মতামত দেয়নি বলে জানা যায়।

জানা যায়, বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন যথাক্রমে ৭০০ কোটি টাকা এবং ৪১৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা। চলতি বছরের গত জুন শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৪৭ কোটি ২২ লাখ টাকা। তবে মূলধন বাড়াতে ২০১৮ সালের ১২ জুন ৬০০ কোটি টাকার ৭ বছর মেয়াদি সাবঅরডিনেটেড বন্ড’ ইস্যু করেছিল রূপালী ব্যাংক।

এটি বাদ দিলে মূলধন ঘাটতি দাঁড়ায় ১৪৪৭ কোটি ২২ লাখ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় মূলধন পুনঃভরণ বাবদ সরকার রূপালী ব্যাংককে মোট ৬৮০ কোটি টাকা দিয়েছে, যা ব্যাংকটির হিসাব বিবরণীতে শেয়ার মানি ডিপোজিট’ হিসাবে সংরক্ষিত রয়েছে। জানা যায়, ইতঃপূর্বে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’-এ প্রেরিত এক প্রস্তাবে ২০ টাকা প্রিমিয়াম হিসেবে রাইট শেয়ারের সাবস্ক্রিপশন মূল্য বাবদ সরকারের কাছে অতিরিক্ত ১৬৭৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা চেয়েছিল রূপালী ব্যাংক।

সূত্রমতে, সরকারের মূলধন সহায়তার বিপরীতে গত ১০ বছরে (২০১০-২০১৯) বিভিন্ন খাতে সরকারি কোষাগারে নগদ মোট ৩ হাজার ১৬৮ কোটি ৮ লাখ টাকা জমা দিয়েছে রূপালী ব্যাংক। আলোচ্য সময়ে সরকারের কার্যক্রম বিনামাশুলে ও স্বল্প চার্জে সম্পাদন করায় ব্যাংকটি প্রায় ৯৬১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা মুনাফা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

সব মিলিয়ে গত ১০ বছরে নগদ অর্থ ও সেবা বাবদ রূপালী ব্যাংক সরকারকে ৪ হাজার ১২৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা দিয়েছে। উল্লেখ্য, রূপালী ব্যাংক ১৯৮৬ সাল থেকে পুজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত একটি ব্যাংক। গতকাল পর্যন্ত এই ব্যাংকের ৯০.১৯ শতাংশ শেয়ার সরকারের হাতে রয়েছে। বাকি শেয়ারের ৪.৮৩ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং অবশিষ্ট ৪.৯৮ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে।