তৌফিক ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: অভিযুক্ত সিন্ডিকেটের কাছেই এখনো জিম্মি পুঁজিবাজার। চিহ্নিত এই কারসাজি সিন্ডিকেট কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না। দিনের পর দিন একই ধরনের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে চলছে। এ কারসাজির সাথে বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালকরা জড়িত রয়েছে। ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের কারসাজির ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব ব্যক্তির নাম এসেছিল তারা এখনো নিয়ন্ত্রক কারসাজির। প্রতিকারে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষও কোনো কিছুই করতে পারছে না। মামলা, জরিমানা করার পরও তাদের কারসাজি থামছে না। পুঁজিবাজারে এখন এদের পরিচয় শেয়ার কারসাজির মাফিয়া সিন্ডিকেট হিসেবে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলার বিচার না হওয়ায় বেপরোয়া এসব ব্যক্তি। জালিয়াতি, কারসাজি থামাতে হলে শেয়ার কারসাজির প্রমাণ পেলে এদের আজীবন নিষিদ্ধ করা উচিত। এ ছাড়া ক্ষুদ্র কোম্পানির শেয়ার আপলোডের ক্ষেত্রে বিএসইসির আরও সতর্ক হওয়া উচিত।

বাজার চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০ সালের বড় ধরনের ধসের অন্যতম কারণ ছিল কারসাজি। এরপরে গত দশ বছরে শেয়ারবাজারে ব্যাপক সংস্কার সত্ত্বেও কারসাজি বন্ধ হয়নি। একশ্রেণির অসাধু বিনিয়োগকারী ও কোম্পানির মালিকপক্ষ কারসাজির আশ্রয় নিয়ে লাভবান হচ্ছেন। এর শিকার হয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বারবার পুঁজি হারাচ্ছেন। ধসের পর এত দীর্ঘ সময়েও শেয়ারবাজার যে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না, তার বড় কারণ এটি। কারসাজি প্রতিরোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শিথিলতাকে দায়ী করেছেন অনেকেই।

এদিকে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি স্টাইলক্র্যাফট লিমিটেডর শেয়ার কারসাজির প্রমাণ পেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি)। ফলে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ওমর গোলাম রব্বানীসহ তিন কর্মকর্তাকে আইন ভঙ্গের দায়ে মুনাফার অধিক জরিমানা করেছে বিএসইসি। বিএসইসি সূত্রে এ তথ্য জানা যায়। আজ বুধবার বিএসইসির ৭৪৯তম কমিশন সভায় এ জরিমানার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

সূত্র মতে, স্টাইলক্র্যাফট লিমিটেডের শেয়ার লেনদেনে সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন (সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ) বিধিমালা ১৯৯৫ এর বিধি ৪(১) এবং সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ ওডিয়েন্স ১৯৬৯ এর সেকশন ১৭(ই)(ভি) ভঙ্গ করেছে। কারসাজিতে জড়িত ছিলো কোম্পানির চেয়ারম্যান ও তিন জন কর্মকর্তাসহ কতিপয় ব্যাক্তি। ফলে কারসাজি করে যা আয় করেছে তার চেয়ে বেশি টাকা জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। তবে কারো নাম প্রকাশ করেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ড. আবু আহমেদ বলেন, ‘পুঁজিবাজারে যারা কারসাজি করে, তাদের নজর থাকে স্বল্প মূলধনী ও কম শেয়ার রয়েছে এমন কোম্পানির দিকে। কারণ এসব কোম্পানি অপেক্ষাকৃত কম পুঁজি নিয়ে তারা গেম করতে পারে। আর পেছনে মালিকপক্ষ জড়িত থাকে। আর তাদের ফাঁদে পা দেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। সর্বশেষ তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ ব্যাপারে বিএসইসির আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে।’

এ বিষয়টি জানতে বিএসইসিতে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হচ্ছে মাঝেমধ্যে। বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। দ্রুত এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

তবে এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু জরিমানা করা ছাড়া কারসাজির বড় হোতাদের অনেক ক্ষেত্রে আইনের মুখোমুখি করতে পারেনি সংস্থাটি। কারণ ঘটনার নেপথ্যে প্রভাবশালীরা। প্রতিবেশী ভারতের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কারসাজির ঘটনায় সে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীকে জেলে দিয়েছে। আমাদের দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ভয় পায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শেয়ার কারসাজি বেশি। এ ক্ষেত্রে ইনসাইডার ট্রেডিংটাই মুখ্য ভূমিকা রাখে।’ মূল্যবোধের অবক্ষয়কে এ ক্ষেত্রে প্রধান কারণ মনে করেন তিনি। এসইসির সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, ‘কোনো কোম্পানির মুনাফা বা ব্যবসাসংক্রান্ত তথ্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও গোপন রাখেন না। এদের অনেকেই বেনামে শেয়ার ব্যবসা করেন।’