দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর পুঁজিবাজারের মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলো নিয়ে আশাবাদ তৈরি হয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। সম্প্রতি বাজার চাঙ্গা হওয়ায় মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর আয় আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারাও বিভিন্ন সময়ে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এখন মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করে অনেক বিনিয়োগকারী ফেঁসে গেছেন। খাতটির প্রতি বিনিয়োগকারীদের ঝোঁক বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু মিউচুয়াল ফান্ডের দরবৃদ্ধি পাওয়ায় তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

আর তদন্তের ঘোষণায় দরপতন শুরু হলে সম্ভাবনার এই খাতটি ঘিরে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ডেকে এনে বিনিয়োগ করানোর পর এখন লোকসানে পড়ায় বিনিয়োগকারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। একসঙ্গে পাঁচটি মিউচুয়াল ফান্ডে তদন্ত কমিটির ঘোষণায় বিনিয়োগকারীরা এসইসির প্রতি দ্বৈতনীতির অভিযোগ তুলছেন। সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ বীমা কোম্পানির শেয়ার দর আট গুণ পর্যন্ত বাড়লেও এসইসি সেখানে কোনো অস্বাভাবিকতা না দেখায় এমন অভিযোগ উঠেছে। তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণায় গত দুই কার্যদিবসে মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটের দর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।

২০১০ সালের ধস এবং সম্পদ কয়েকটি ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা ও লোভের কারণে গত এক যুগ ধরে মিউচুয়াল ফান্ডে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছিল। এতে করে অধিকাংশ মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড অভিহিত মূল্যের নিচে কেনাবেচা হচ্ছিল। তবে নতুন কমিশন আসার পর বাজারে চাঙ্গাভাব ফিরে এলে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর সম্পদমূল্য বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের লোকসান কাটিয়ে চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ফান্ডগুলো ভালো মুনাফা করে। এ সময় ৩৭টি মিউচুয়াল ফান্ডের সবগুলো মুনাফায় ফিরে আসে।

মিউচুয়াল ফান্ডে আস্থা ফেরাতে এসইসিও উদ্যোগ গ্রহণ করে। মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর বিনিয়োগ ও আর্থিক তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে কমিশন। মিউচুয়াল ফান্ডকে ভাইব্রেন্ট বা চাঙ্গা করতে অক্টোবর মাসে খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান, সদস্যরা এবং কমিশনের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সভা-অনুষ্ঠানে অবিরত নানা সংস্কারের কথা বলে এ খাতে বিনিয়োগে বিনিয়োগকারীদের অনুপ্রাণিত করেন।

গত ১২ অক্টোবর কমিশনের সঙ্গে সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে ব্যাংকের এফডিআরের মতো আস্থাশীল করতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়। গত ২৭ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম জানান, যেসব বিনিয়োগকারীর পুঁজিবাজার সম্পর্কে ধারণা কম, তাদের জন্য বিকল্প বিনিয়োগের জায়গা হচ্ছে মিউচুয়াল ফান্ড।

তিনি জানান, বর্তমানে যেসব মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে, সেগুলোর বছরে ১০ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। গত ১১ অক্টোবর বিশ^ বিনিয়োগকারী সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিনিয়োগকারীদের পুঁজির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে এসইসির চেয়ারম্যান বলেন, মিউচুয়াল ফান্ডকে এফডিআরের বিকল্প করা গেলে বিনিয়োগ নিরাপদ ও লাভজনক হবে।

কমিশনের এমন আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিনিয়োগকারীরা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন। আবার বাজার পরিস্থিতি চাঙ্গা হওয়ায় চলতি জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকেও সবগুলো মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদমূল্য ও আয় বাড়তে দেখা গেছে। এ সময় ৩৭টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ২০টির ইউনিটপ্রতি আয় প্রথম প্রান্তিকে এক টাকার বেশি হতে দেখা যায়। এসইসির আহ্বান ও ফান্ডগুলোর পারফরমেন্সের কারণে দীর্ঘদিন পর মিউচুয়াল ফান্ড খাতে বিনিয়োগকারীদের ঝোঁক তৈরি হয়।

ফলে চাহিদা বেড়ে গিয়ে মিউচুয়াল ফান্ডের দরও বাড়তে থাকে। যদিও এখনো অধিকাংশ মিউচুয়াল ফান্ড অভিহিত মূল্যের নিচে কেনাবেচা হচ্ছে। কোনো কোনো মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট সম্পদ মূল্যের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ কমে বিক্রি হচ্ছে। খাতটিতে যখন গতি ফিরতে শুরু করেছে ঠিক সে সময় তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ফলে মিউচুয়াল ফান্ডের গতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত দুই দিনেই তা স্পষ্ট হয়েছে। এসইসির আহ্বানে বিনিয়োগ করে এখন বড় ধরনের লোকসানে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

সরকারের নানা উদ্যেগের ফলে দীর্ঘ মন্দাভাব কাটিয়ে পুঁজিবাজার মাত্রই স্থিতিশীলতার পথে হাঁটতে শুরু করেছে। পুঁজিবাজারের চাঙ্গাভাবে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর সম্পদমূল্য বাড়ার প্রভাব পড়তে শুরু করে ফান্ডগুলোর বাজারদরে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণায় দীর্ঘমেয়াদে মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিনিয়োগকারীরা।

তাদের অভিযোগ বীমা খাতে পুনরায় চাহিদা তৈরি করতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। করোনার কারণে উৎপাদনশীল খাতের আয় কমে যাওয়ায় গত কয়েক মাসে বীমা খাতের ওপর অতিমাত্রায় ঝোঁক তৈরি হয়। ফলে সাধারণ বীমা খাতের শেয়ারদর স্বল্পতম সময়ে দুই থেকে আট গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। যদিও বীমা খাতের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধিতে এসইসি কোনো তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়নি বলে বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেন।

এ বিষয়ে বিএসইসি চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম গত মঙ্গলবার বলেন, শুধু মিউচুয়াল ফান্ড নয়, বীমা খাতের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে। তবে বীমা খাতের তদন্তের বিষয়টি ডিসক্লোজ করা হয়নি। বীমা খাতের তদন্তে সিকিউরিটিজ আইন ভঙ্গের প্রমাণ আমরা পেয়েছি, যাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।