দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের পুঁজিবাজারে মহা ধসের দশ বছর পার হলেও সেই ক্ষত এখনো শুকায়নি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের উদ্যোগ এবং বর্তমান কমিশনের আমলে পুঁজিবাজারমুখী সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও মাঝে মধ্যে সূচকের কারেকশন হচ্ছেই। ফলে ২০১০ সালের ধসে পুঁজিহারা বিনিয়োগকারীরা এখনো আটকে আছেন লোকসানের বৃত্তে।

এদিকে বিএসইসির নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশকিছু ইতিবাচক নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। যার দরুন ৩১ মে ২০২০ তারিখে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) পুনরায় চালু হওয়ার পর, দীর্ঘ দিনের মন্দাভাব কেটে বাজার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় ফিরে। সরকারের ইতিবাচক মনোভাব ও কমিশনের বেশকিছু ভালো সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদেরকে আশান্বিত করে।

ধীরে ধীরে সূচক বাড়তে থাকে, যা বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসকে ফিরে আনতে সক্ষম হয়। এতে তারা বাজারে আবারও সক্রিয় হতে থাকে। এমনকি যারা এতোদিন বাজার বিমুখ ছিলো তারাও ধীরে ধীরে বাজারে বিনিয়োগ করতে শুরু করে।

যার দরুন বাজারের প্রধান সূচক পাঁচ হাজার পয়েন্টের মনস্তাত্বিক মাইল ফলক আবারও অতিক্রম করে। এর সঙ্গে লেনদেনও বাড়তে থাকে এবং গড় লেনদেন প্রায় হাজার কোটি টাকার ঘর ছাড়িয়ে যায়। সবকিছু মিলিয়ে বাজার ঠিকভাবেই চলছিল, কিন্তু গত ১৬ সেপ্টেম্বরের পর থেকে বাজার আবারও নিম্নমুখী ধারায় ফিরে যায়। মাঝখানে দুই-এক দিন সামান্য ইতিবাচক ধারায় ফিরলেও তা ধরে রাখতে পারেনি। কী এমন হল যে, আশার আলো জাগায়ে বাজার আবারও মন্দা অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে?

এদিকে পুঁজিবাজারে সম্প্রতি পতনমুখী প্রবণতা বিরাজ করছে। প্রায় দিনই কমছে সূচক। পাশাপাশি কমে যাচ্ছে লেনদেন হওয়া বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার এবং মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটদর। এর জের ধরে কমে যাচ্ছে লেনদেনও। সম্প্রতি লেনদেন ৬০০ কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে। গত রোববার ৫০০ কোটি টাকার নিচে নেমে আসে। যদি সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে সূচকের পতন হলেও লেনদেন কিছুটা বাড়ছে। এদিকে হঠাৎ করে লেনদেনে এত ছন্দপতনে সকলকে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে। মূল্যসূচক ও লেনদেনের উর্ধ্বমুখী ধারায় পড়েছে ছেদ। বিশেষ করে গত কয়েকদিনে বাজারে লেনদেনের পরিমাণ অনেক কমে গেছে।

গত ১৫ নভেম্বর দেশের প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রায় ১২শ কোটি টাকা মূল্যের শেয়ার কেনাবেচা হয়েছিল। এক সপ্তাহের ব্যবধানে আজ তা ৫শ কোটি টাকার নিচে নেমে আসে। গত সাড়ে তিন মাসের মধ্যে এটিই সর্বনিম্ন লেনদেন। লেনদেনের এই বড় পতনকে ঘিরে বিনিয়োগকারীদের কৌতুহল ও উদ্বেগের শেষ নেই। অনেকের মধ্যেই আশংকা, বাজার কী আবার আগের অবস্থার দিকে ফিরে যাচ্ছে? তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাজার নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু নেই। কয়েকটি কারণে বাজারে একটু ধীর গতি চলছে। কিছু দিনের মধ্যেই বাজার আবার তার গতিশীলতা ফিরে পাবে।

এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে লেনদেন হ্রাস পাওয়ার জন্য বাজারে আইপিও আবেদন চলমান থাকাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট সবাই। বর্তমানে বাজারে চলছে বহুজাতিক কোম্পানি রবির আইপিও। এ কারণে অনেকেই সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ না করে আইপিওতে আবেদন করছেন। একইভাবে যারা বাজারে সক্রিয় রয়েছেন তারা ভিন্ন নামে বিও অ্যাকাউন্ট করেও রবির আইপিওর জন্য আবেদন করছেন।

অন্যদিকে সম্প্রতি প্রতি মাসেই গড়ে দুটি করে আইপিও থাকছে; যার কারণে হাতে টাকা রেখে দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। যার প্রভাব পড়ছে সেকেন্ডারি মার্কেটে। আর বাজার চিত্র নিন্ম দেখেও অনেকেই নতুন বিনিয়োগ থেকে দূরে সরে রয়েছেন। সব মিলে সেকেন্ডারি মার্কেট তার স্বাভাবিক চিত্র হারাচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, লেনদেন ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকলেও চারটি বিষয়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এগুলো হচ্ছে-অল্প সময়ের ব্যবধানে অনেক আইপিও আসা, বিমা খাতের শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডে বিপুল বিনিয়োগ আটকে যাওয়া, তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানির লভ্যাংশ ঘোষণা শেষ হয়ে যাওয়া, বেশিরভাগ কোম্পানির মন্দ পারফরম্যান্স, সম্প্রতি পাঁচটি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের তদন্তের খবর, ফ্লোর প্রাইস নিয়েও গুজব।

ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী লেনদেনের গতি হারানোর বিষয়ে বলেন, মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আইপিওর মাধ্যমে ৫০০ কোটি টাকা উত্তোলন করছে। এর আগেও কয়েকটি কোম্পানি বাজার থেকে টাকা উত্তোলন করেছে। এতে বিনিয়োগকারীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ সাময়িকভাবে আটকে যাচ্ছে। ফলে বাজারটা এখন স্লো যাচ্ছে।

রবি’র (আইপিওর সাবক্রিপশন চলছে) প্রেমে পাগল হয়ে মার্কেট পড়ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট ছায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, নতুন কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়া কিংবা সাবস্ক্রিপশনে আসার ২-৩ দিন আগে ও পরে মার্কেট ডাউন থাকে। বিনিয়োগকারীরা টাকা তুলে ক্যাশ করে রাখেন ভালো কোম্পানি হলে এই ক্যাশ টাকা নতুন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। আর ভালো কোম্পানি আইপিওতে আসলে আবেদন করেন।

তিনি বলেন, রবিসহ বেশ কিছু কোম্পানির আইপিওর কাছাকাছি সময়ে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এগুলো বাজারে আসছে। তাতে বিনিয়োগ করছে ফলে সেকেন্ডারি মার্কেটে তার প্রভাব পড়ছে। তবে নতুন কোম্পানির সাবক্রিপশন বাজারের জন্য কোনো প্রবলেম না। জাস্ট সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম। আশার করছি আগামী সপ্তাহ থেকে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।

ইউসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রহমত পাশা বলেন, আইপিওতে কিছু টাকা চলে যাওয়ার পাশাপাশি ইন্স্যুরেন্স এবং মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করে অনেক বিনিয়োগকারী আটকে আছেন। ফ্লোর প্রাইসের কারণে অনেক কোম্পানির শেয়ার কেনা-বেচা করা যাচ্ছে না। বাজারে এসব বিষয়ের প্রভাব পড়েছে। তবে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে বেশ কিছু কোম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়নি। এছাড়াও ভালো ভালো কোম্পানির ইপিএস খারাপ এসেছে প্রথম ও তৃতীয় প্রান্তিকে এর ফলে নেতিবাচ প্রভাব পড়েছে।

এছাড়া সর্বশেষ চার মাসে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স, এসোসিয়েট অক্সিজেন, ডমিনেজ স্টীল বিল্ডিং সিস্টেম লিমিটেড, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, কোম্পানি লিমিটেড এবং রবি আজিয়াটা লিমিটেড ইত্যাদি। এক মাসে ৩-৪টি কোম্পানির আইপিওর সাবক্রিপশন থাকায় এই অন্তত ৬-৭ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। ফলে বাজারে তারল্য প্রবাহ কমে গেছে।

এছাড়া সম্প্রতি পাঁচটি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের তদন্তের খবরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফলে নতুন করে আস্থার সংকট দেখো দেয়। এটিকে কেন্দ্র করে নানা গুজব সৃষ্টি করে একটি মহল। বাজার জুড়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে বীমা খাতের যেসব শেয়ারের দর বেড়েছে তাদের বিষয়েও তদন্ত হবে। একই সঙ্গে গুজব রয়েছে ফ্লোর প্রাইস নিয়েও।

তবে বেশি বিতর্ক সৃষ্টি হয় মিউচ্যুয়াল ফান্ডের তদন্তের বিষয়টি নিয়ে। কেউ কেউ বলছেন ৯ টাকার মিউচ্যুয়াল ফান্ড ১১ টাকা হলে যদি তদন্ত হয়, তাহলে ১৪ টাকা থেকে একটি বীমার শেয়ার ১০০ টাকা হয়েছে, সেটার বিষয়ে কেন তদন্ত হচ্ছে না? এসব কারনে দেশের শেয়ারবাজারের লেনদেনের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

এ বিষয়গুলো নিয়ে একটি অনলাইন পোর্টালের সাথে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নজরে আনলে তিনি এ বিষয়ে বিএসইসির অবস্থান পরিস্কার করেন।

তিনি জানিয়েছেন, পাঁচটি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের কোন সিরিয়াল ট্রেডিং হয়েছে কিনা সে বিষয়গুলো দেখার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অলরেডি এবিষয়গুলোও চিহ্নিত করতে পেরেছে তদন্ত কমিটি। এখানে সাধারন বিনিয়োগকারীদের ভয়ের কোন কারন নেই। একই সঙ্গে ইন্সুরেন্সের শেয়ারের ক্ষেত্রেও। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদেরকে একটি শ্রেনীর মানুষ ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে,যা ভিত্তিহীন।