দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশে পরিচালিত মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর বিরুদ্ধে নেটওয়ার্ক, কলড্রপ, কভারেজ, ডেটা স্পিড ও এমএনপিসহ নানা ধরনের অভিযোগ বাড়ছে গ্রাহকের। চলতি বছর আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) দেশের তিনটি বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রাহকদের কল ড্রপ হয়েছে প্রায় ১০৮ কোটি ৮৩ লাখ ৩৮ হাজার কল মিনিট। এসব অভিযোগের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে রবি আজিয়াটা ও গ্রামীণফোন।

এদিকে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না নেটওয়ার্ক সক্ষমতা। ফলে কল ড্রপ বাড়ছেই। আর কল ড্রপের জন্য অপারেটরগুলো দায় চাপাচ্ছে টাওয়ার শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর ওপর। কেননা প্রায় তিন বছর আগে মোবাইল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে টাওয়ার শেয়ারিং কোম্পানিগুলো লাইসেন্স নিলেও কাজে আশানুরূপ গতি আসেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে উন্নত প্রযুক্তির আগমন হলেও গ্রাহকরা মানসম্মত সেবা পাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত গ্রাহকরা প্রতারণার শিকার হলেও যে পরিমাণ গ্রাহক ভোক্তা অধিকার বা বিটিআরসিতে অভিযোগ করে, প্রকৃতপক্ষে অভিযোগকারীর সংখ্যা অনেক বেশি। শুধুমাত্র যে গ্রাহকগুলো খুব বেশি সচেতন বা যারা ঢাকা সিটিতে বাস করে এমন কিছু কিছু গ্রাহকই মাত্র অভিযোগ করে।

ঢাকার বাইরে অর্থাৎ সারা দেশে বিপুল সংখ্যক গ্রাহক নানাভাবে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হচ্ছে। গ্রামে অনেক গ্রাহক রয়েছে যারা প্রতারণা বা হয়রানির শিকার হলে অভিযোগ করা যায় সেই বিষয়টিও তারা জানেই না।

তারা আরও জানায়, দেশে উন্নত প্রযুক্তি ফোরজিসেবা চালু হলেও মানসম্মত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। বরং নেটওয়ার্ক অসক্ষমতা ও কল ড্রপ বাড়ছে। ঢাকার বাইরে অনেক এলাকায় এখন নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক থাকে না। গ্রামের অনেক গ্রাহক প্রযুক্তির সম্পর্কে জ্ঞানহীন, তারা প্রতারণার শিকার হলেও বুঝতে পারেন না। আবার কেউ বুঝলেও সংশ্লিষ্ট জায়গায় অভিযোগ করতে পারেন না।

বাংলাদেশ টেলিযোগযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, চলতি বছর আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) দেশের তিনটি বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রাহকদের কল ড্রপ হয়েছে প্রায় ১০৮ কোটি ৮৩ লাখ ৩৮ হাজার কল মিনিট। এর বিপরীতে ফেরত দেওয়া হয়েছে মাত্র আট কোটি ২৪ লাখ ৭৩ হাজার কল মিনিট, যেটি গ্রাহকদের কল ড্রপের তুলনায় খুবই সামান্য। আর এ সময়ে সবচেয়ে বেশি কল ড্রপ হয়েছে রবি আজিয়াটার গ্রাহকদের।

তথ্যমতে, একই সময়ে রবি আজিয়াটার আট মাসে কল ড্রপ হয়েছে প্রায় ৪৮ কোটি ১৭ লাখ ২৩ হাজার কল মিনিট, যা তিন অপারেটরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রবি থেকে অন্য অপারেটরে ফোন করতে গিয়ে দুই বা তারও বেশি কল ড্রপ হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি ৫৮ লাখ ৯৩ হাজার বার। রবি থেকে রবিতে কল করতে গিয়ে দুই বা তারও বেশি ড্রপ হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি ৯৪ লাখ ৫২ হাজার।

কল ড্রপের বিপরীতে ফেরত দেওয়া হয়েছে তিন কোটি ৯২ লাখ ৪০ হাজার মিনিট। এ বিষয়ে জানতে রবি আজিয়াটার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোম্পানিটি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। অন্যদিকে আট মাসে গ্রামীণফোনের (জিপি) কল ড্রপ হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি এক লাখ ১৯ হাজার কল মিনিট। এর মধ্যে গ্রামীণফোন থেকে অন্য অপারেটরে ফোন করতে গিয়ে দুই অথবা তারও অধিক কল ড্রপ হয়েছে প্রায় আট কোটি ৩৬ লাখ ৪৫ হাজার।

আর জিপি টু জিপিতে ফোন করতে গিয়ে দুই অথবা তারও অধিক কল ড্রপ হয়েছে প্রায় এক কোটি ১১ লাখ ২৭ হাজার। আর কল ড্রপের বিপরীতে ফেরত দেয়া হয়েছে প্রায় তিন কোটি ২৯ লাখ কল মিনিট। একই সময়ে বাংলালিংকের কল ড্রপ হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি ৬৫ লাখ ১৫ হাজার মিনিট। বাংলালিংক থেকে অন্য অপারেটরে ফোন করতে গিয়ে দুই বা তারও বেশি কল ড্রপ হয়েছে প্রায় দুই কোটি ১০ লাখ ৮৪ হাজার মিনিট।

আবার বাংলালিংক টু বাংলালিংকে ফোন করতে গিয়ে দুই বা তারও বেশি কল ড্রপ হয়েছে প্রায় দুই কোটি ৭০ লাখ মিনিট। কল ড্রপের বিপরীতে ফেরত দেওয়া হয়েছে মাত্র এক কোটি তিন লাখ মিনিট।

মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর তথ্যমতে, ‘কয়েকটি বিষয়ের ওপর কল ড্রপ নির্ভর করে। এটি একেবারে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে এর মান ভালো করা সম্ভব। বর্তমানে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর হ্যান্ডসেট ব্যবহার বৃদ্ধি পেলেও নেটওর্য়াক সম্প্রসারণে কাজ করার ক্ষেত্রে কিছুটা বাধা রয়েছে। কেননা বর্তমানে মোবাইল টাওয়ারগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে টাওয়ার শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান। যে কারণে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে ধীরগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।’

এ বিষয় জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামীণফোনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রেডিও প্রযুক্তি নির্ভর মোবাইল সেবায় কল ড্রপ একটি স্বাভাবিক উপসর্গ। গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্কে কল ড্রপের পরিমাণ সব সময়ই বিটিআরসি ও আন্তর্জাতিক নির্ধারিত মানদণ্ডে অনেক নিচে রয়েছে। গ্রাহকসংখ্যার বিচারে গ্রামীণফোনের কল ড্রপের পরিমাণ অন্যান্য অপারেটরের তুলনায় অনেক কমই রয়েছে। গ্রাহকের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে গ্রামীণফোন গ্রাহকের কল ড্রপের ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে।’

উল্লেখ্য, গ্রাহকদের সেবার মান বাড়াতে ‘কোয়ালিটি অব সার্ভিস’ (কিউওএস) নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। এই নীতিমালা অনুযায়ী মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর নেটওয়ার্ক ও দুর্বল নেটওয়ার্ক কাভারেজ, ইন্টারনেটের উচ্চমূল্য, ভয়েস কলের নিম্নমান এবং গ্রাহকসেবার অসন্তুষ্টি দূর করা হবে। মোবাইলে কথা বলার (ভয়েস কল) সময় কল ড্রপের হার হতে হবে দুই শতাংশের কম। কোনো অপারেটর নীতিমালা উপেক্ষা করলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে নীতিমালায়।

এ বিষয় মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর কল ড্রপ প্রতিনিয়ত বাড়লেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় গ্রাহক পর্যায়ে ভোগান্তি বাড়ছে। দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও নেটওয়ার্ক কভারেজ বাড়েনি। কল ড্রপের মাধ্যমেও অপারেটরগুলো অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করছে।’