দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে চলতি ২০২০ সালে নতুন করে কোনো ঋণ খেলাপি হচ্ছে না। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশনিং) রাখতে হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোর মুনাফার পরিমাণ এখন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। কারণ নতুনভাবে কোনো ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত না হওয়ায় ব্যাংকগুলোকে মুনাফা থেকে এখন নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হচ্ছে না। এতে তাদের মুনাফা বাড়ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) প্রজ্ঞাপন জারি করে ব্যাংকগুলোর মুনাফায় লাগাম টেনে দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপনে বলেছে, বিশেষ হিসাবে থাকা বা স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্টের (এসএমএ) ঋণ ও সব ধরনের ভালো ঋণের ওপর অতিরিক্ত ১ শতাংশ হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশনিং) রাখতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলো তাদের কোন ঋণের সুদকে আয় খাতে নিতে পারবে, তা–ও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এভাবেই চলতি বছরের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। এর ফলে ব্যাংক খাতে ভবিষ্যতে যেসব ঋণ খারাপ হয়ে পড়বে, তা সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া, কাগজে-কলমে মুনাফা দেখানোর কৌশল বন্ধ হয়ে গেল ব্যাংকগুলোর।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯–এর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল যে পয়লা জানুয়ারিতে ঋণের শ্রেণিমান যা ছিল, ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই ঋণ তার চেয়ে বিরূপ মানে শ্রেণীকরণ করা যাবে না। তবে কোনো ঋণের শ্রেণিমানের উন্নতি হলে তা যথাযথ নিয়মে শ্রেণিকরণ করা যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ভবিষ্যতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি সুদৃঢ় রাখা এবং ঝুঁকি নেওয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিস্তি পরিশোধ ও সমন্বয়ের জন্য সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণের ওপর আরোপিত সুদ ব্যাংকের আয় খাতে স্থানান্তরকরণ এবং ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে। এর ফলে কিস্তি পরিশোধের বাড়তি সুবিধার কারণে যেসব ঋণ অশ্রেণীকৃত অবস্থায় রয়েছে, সেই সব ঋণের বিপরীতে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আরোপিত সুদ নগদ আদায় ছাড়া আয় খাতে স্থানান্তর করতে হলে সম্ভাব্য আদায় ঝুঁকি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ১০ কোটি টাকা ও এর চেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণের (ঋণগ্রহীতাভিত্তিক) বিপরীতে আরোপিত সুদ আয় খাতে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের পর্যালোচনা (যৌক্তিকতা উল্লেখ করে) নির্বাহী কমিটির সুপারিশসহ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯–এর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল যে পয়লা জানুয়ারিতে ঋণের শ্রেণিমান যা ছিল, ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই ঋণ তার চেয়ে বিরূপ মানে শ্রেণীকরণ করা যাবে না। তবে কোনো ঋণের শ্রেণিমানের উন্নতি হলে তা যথাযথ নিয়মে শ্রেণিকরণ করা যাবে।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ৫ কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকার কম পরিমাণ ঋণের (ঋণগ্রহীতাভিত্তিক) বিপরীতে আরোপিত সুদ আয় খাতে স্থানান্তরের বেলায় শাখাপ্রধানের সুপারিশসহ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। এ ছাড়া পাঁচ কোটি টাকার কম ঋণের বিপরীতে আরোপিত সুদ আয় খাতে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে শাখাপ্রধানের সুপারিশসহ তাঁর নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে।

এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কোনো ঋণের বিপরীতে আরোপিত সুদ আয় খাতে স্থানান্তর করা না হলে তা ইন্টারেস্ট সাসপেন্স হিসাবে’ স্থানান্তর করতে হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়, ঋণের বিপরীতে স্পেসিফিক বা সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ঋণের শ্রেণীকরণ ও নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের বিধান অনুযায়ী হিসাবায়ন করতে হবে। যথাযথ হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে।

এদিকে ৩১ ডিসেম্বরভিত্তিক হিসাব চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে বিশেষ হিসাবে তথা স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্টে (এসএমএ) থাকা ঋণসহ সব অশ্রেণীকৃত ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত ১ শতাংশ হারে সাধারণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ (প্রভিশনিং) করতে হবে। এ নিরাপত্তা সঞ্চিতিকে আলাদা হিসাবে রাখতে হবে এবং পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত তা আয় খাতে নেওয়া যাবে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৬৩ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড ঋণ ৯ লাখ ২৪ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা ও এসএমএ ঋণ ৪৪ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত ৯ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এভাবে লাগাম টানার ফলে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত ব্যাংকগুলোর মুনাফায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে আগামী বছর ব্যাংকগুলো শেয়ারহোল্ডারহোল্ডারদের ভালো ডিভিডেন্ড দিতে সক্ষম হবে না।