আবদুর রাজ্জাক, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আলাদিনের চেরাগের মতো পুঁজিবাজারের মাধ্যমেও রাতারাতি বড় লোক হওয়া যায়, সেই কল্পিত কথাই যেন সত্যি করে দেয়ার ব্রত নিয়েছে পুঁজিবাজারের ২০ কোম্পানি। গত ছয় মাসের মধ্যেই কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বেড়েছে কোনটার দশগুনের বেশি। এখন পুঁজিবাজারে এই ২০ কোম্পানি ২০২০ সালে আলাদিনের চেরাগে পরিনত হয়েছে।

এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে কেউ কেউ ১০ গুনের বেশিও মুনাফা করছেন। মুলত স্বল্প মূলধনী বীমা খাতের কয়েকটি কোম্পানি এবং বেক্সিমকো গ্রুপের শেয়ার এবং দুর্বল মৌল ভিত্তি খাতের ঝিলবাংলা ও শ্যামপুর সুগারে বিনিয়োগ করে এমন ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যায়। এ যেন আলাদিনের চেরাগ। এরই মধ্যে এশিয়া ইন্সুরেন্স, প্যারামাউন্ড ইন্সুরেন্স, প্রভাতী ইন্সুরেন্স, বেক্সিমকো লিমিটেড ও বেক্সিমকো ফার্মা এবং ঝিলবাংলা সুগারের শেয়ার রূপকথার আলাদিনের চেরাগকে হারিয়ে দিয়েছে।

কোনো ধরনের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছাড়াই লাগামহীনভাবে বেড়েছিল এ কোম্পানির শেয়ার দর। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে ৪০০ শতাংশের বেশি বেড়েছিল ঝিলবাংলা সুগারের শেয়ার দর, যা অবাক করেছে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সবাইকে। অবাক কোম্পানি কর্তৃপক্ষও। তারাও অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বৃদ্ধির কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। তেমনি বিমা খাতের কোম্পানি এশিয়া ইনস্যুরেন্সের দাম গত ৩১ মে ছিল ১৭ টাকা।

টানা শেয়ারের দর বাড়তে বাড়তে গত বুধবার দাঁড়িয়েছে ১০৭ টাকা, সে হিসেবে ৫২৯ শতাংশ শেয়ারের দর বাড়ছে। অপর কোম্পানি প্যারামাউন্ট ইনস্যুরেন্সের ৩২ টাকার শেয়ার এক বছরের ব্যবধানে হয়ে গেছে ১৩০ টাকা। দাম বেড়েছে ৩০৬ শতাংশ বা ৯৮ টাকার বেশি। তবে কোম্পানির সর্বমোট শেয়ারের দর উঠেছিল ১৬১.৩০ টাকা। ২০০৭ সালে তালিকাভুক্ত প্যারামাউন্ট সর্বশেষ ২০১৯ সালে শেয়ারধারীদের মাত্র ৪ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্সুরেন্স গত মার্চ মাসে ১৪ টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৭৩.৫০ টাকা। সেই হিসেবে ৫ গুনের বেশি দর বাড়ছে কোম্পানিটির। এছাড়া প্রভাতী ইন্সুরেন্সের শেয়ারের দর গত ১ বছরে ১৬ টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে ৮৪ টাকায় দাঁড়িয়েছে। তেমনি বেক্সিমকো গ্রুপের বেক্সিমকো লিমিটেডের গত ছয় মাসের ব্যবধানে ১৩ টাকার শেয়ার এখন ৫৭ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। এছাড়া বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ারের দর গত ছয় মাসের ব্যবধানে ৬০ টাকা থেকে এখন ১৯০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ১ বছরের ব্যবধানে ৫২ টাকা শেয়ার এখন ১৯০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

১০ শতাংশের কম লভ্যাংশ দেওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী, কোম্পানিটি দুই বছরের বেশি সময় ধরে ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত। এশিয়া ও প্যারামাউন্টের শেয়ারের দামের এমন উত্থান দেখে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা এটিকে ‘আলাদিনের চেরাগ’ মনে করতেই পারেন। সেই মনে করাটা আপাতদৃষ্টে মোটেই অন্যায্য হবে না। অন্যায্য বা অযৌক্তিক এমন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পরও বাজার তদারকি সংস্থাগুলোর চুপ করে থাকা।

২০২০ সালে আলাদিনের চেরাগ খ্যাত ২০ কোম্পানি দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এর মধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা, এশিয়া ইন্সুরেন্স, প্যারামাউন্ট ইন্সুরেন্স, এশিয়া ইন্সুরেন্স, এশিয়া প্যাসিফিক ইন্সুরেন্স, বিডি ফাইন্যান্স, জিকিউ বলপেন, সাভার রিফেক্টরিজ, ঝিলবাংলা সুগার, শ্যামপুর সুগার, সিএমপিএম মিউচুয়াল ফান্ড, কন্টিনেন্টাল ইন্সুরেন্স, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্সুরেন্স, গ্লোবাল ইন্সুরেন্স, নিটল ইন্সুরেন্স, রিপাবলিক ইন্সুরেন্স, ইর্স্টান ইন্সুরেন্স পিপলস ইন্সুরেন্স এবং প্রভাতী ইন্সুরেন্স। এসব কোম্পানি শেয়ারের দর গত এক বছরে সর্বনিন্ম দ্বিগুন, তেমনি ১০ গুনের বেশি বাড়ছে এমন কোম্পানি রয়েছে।

সম্প্রতি বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এক অনুষ্ঠানে বিমা কোম্পানির লভ্যাংশ সংক্রান্ত একটি মন্তব্য করেন। সেখানে তিনি কোম্পানিগুলোর কত লভ্যাংশ দেওয়া উচিত, সেই বিষয়ে মন্তব্যও করেন, যা শেয়ারের দামকে প্রভাবিত করে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শেয়ারের দামকে প্রভাবিত করতে পারে, এমন কোনো মন্তব্য করা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের উচিত নয়।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে সেসবের সিংহভাগই স্বল্প মূলধনের বীমা খাতের কোম্পানি। এর পেছনে কারসাজি আছে। পরিকল্পিতভাবেই একটি চক্র এসব শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) উচিত এসব কোম্পানির দাম কেন বাড়ছে তা খতিয়ে দেখা উচিত।

তারা বলছেন, বীমা খাতের স্বল্প মূলধনের হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার সংখ্যা কম। ফলে গুটিকয়েক বিনিয়োগকারী সম্মিলিতভাবে বাজারে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের অস্বাভাবিক চাহিদা সৃষ্টি করতে পারেন। বর্তমানে হয়তো তেমন ঘটনাই ঘটছে। যে কারণে স্বল্প মূলধনের কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম আকাশ কুসুম বাড়ছে। তবে বীমা খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার বিষয় ডিএসই থেকে কোন নোটিস পাঠানো হয়নি।

বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষক মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘বিমা খাতের কোম্পানিগুলো স্বল্প মূলধনি। তাই এসব শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা সহজ। কারসাজিকারীরা অল্প বিনিয়োগ করেই শেয়ারের দাম ইচ্ছেমতো বাড়াতে পারে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি বিমা খাত নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন মন্তব্য করা হয়েছে। এসব মন্তব্য কারসাজিকারীদের আরও বেশি সহায়তা করেছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, গত কয়েক মাসে বীমা খাত সহ কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের দর অস্বাভাবিক বাড়ছে। গত ৩ মাসে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম প্রায় তিনগুন হয়েছে। এর কারণ বাজারে বিনিয়োগকারীদের ছোট একটা অংশ জুয়া খেলছে।

বাজারের এ পরিস্থিতিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভাল কোম্পানির শেয়ার কিনে বসে থাকা উচিত। ভাল অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম এখনও অনেক কম। লম্ফঝম্প না করে, এখানে লাভ, ওখানে লাভ এমন ছোটাছুটি না করে মৌলভিত্তির শেয়ার কেনাই ভাল বলে তিনি মন্তব্য করেন।