তৌফিক ইসলাম ও এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নতুন বছরের শুরুতেই পুঁজিবাজারের বড় উত্থান দিয়ে লেনদেন শুরু হয়েছে। মুলত ২০১০ সালের ভয়াবহ ধসের এক দশক পরে গতি এসেছে পুঁজিবাজারে। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন বছরের দ্বিতীয় কার্যদিবসে লেনদেনের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করছে। বিদায়ী বছরের ছয় আর নতুন বছরের দুই কার্যদিবস মিলে টানা ৮ কার্যদিবস উত্থানে পার করল পুঁজিবাজার। এই সময়ে পুঁজিবাজারে মূল্য সূচক, বাজার মূলধন ও লেনদেনে একের পর এক রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এদিন ডিএসইর লেনদেন ২১’শ কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেনের শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি (বেক্সিমকো) লিমিটেড।

এদিন কোম্পানিটির ২৫৩ কোটি ৯ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২০৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকার। ১২৪ কোটি ২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেড। লেনদেনের চতুর্থ তালিকায় লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ লেনদেন হয়েছে ১০৬ কোটি টাকা এবং আইএফআইসি ব্যাংক লেনদেন হয়েছে ৮৮ কোটি টাকা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

একদিনে করোনা অতিমারীর কারণে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সঙ্কুচিত হওয়া, ব্যাংক আমানতে সুদের হার কমে যাওয়া, সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি এবং পুঁজিবাজারে নিঃশর্তে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ায় পুঁজিবাজার নিয়ে সব ধরনের মানুষের আগ্রহও দেখা যাচ্ছে। নতুন আশায় দীর্ঘদিনের নিষ্কিয় বিনিয়োগকারীরাও আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেছেন বাজারে। গত দুই মাসে দেড় লাখের বেশি বিনিয়োগকারী নতুন পুঁজিবাজারে এসেছেন।

তাদের আশা করোনার মধ্যে ২০২০ সালে যেভাবে পুঁজিবাজার দ্যুতি ছড়িয়েছে ২০২১ সালে আরও তেজিভাব বজায় থাকবে। এছাড়া ভারতে করোনাভাইরাসের টিকা অনুমোদনের খবরে অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার সম্ভাবনার প্রভাব দেখা দিয়েছে দেশের পুঁজিবাজারে। পাশাপাশি কিছু কোম্পানির আয় বৃদ্ধিসংক্রান্ত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য, নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্যোগে বিদায়ী বছরে এশিয়ার সেরা বাজারে সূচক ও লেনদেনের বড় উত্থানে ভূমিকা রেখেছে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পুঁজিবাজারের বড় উত্থানে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলো। যুক্তরাজ্যের পর গত শুক্রবার ভারতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার খবরে বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দর টানা সর্বোচ্চ দর বেড়েছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা কিনতে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। তাই এই অনুমোদনের খবরে বেক্সিমকোর শেয়ারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, করোনাকালে সদ্য বিদায়ী ২০২০ সালে বিশে^র অধিকাংশ দেশের পুঁজিবাজারে চাঙ্গাভাব দেখা দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের পুঁজিবাজারও ধারাবাহিক উত্থানে রয়েছে। নতুন কমিশনের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের নীতি সহায়তা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাভাব ফিরিয়ে আনছে। এরই প্রভাবে করোনার মধ্যে টানা ৬৬ দিনের লকডাউনে পুঁজিবাজার বন্ধ থাকার পরও ২০২০ সালে সূচক বৃদ্ধির তালিকায় এশিয়ার শীর্ষে অবস্থান করছে ডিএসই। এর আগে গত আগস্টেও সূচক বৃদ্ধিতে বিশে^র সেরা পারফর্মিং বাজারের স্বীকৃতি পেয়েছিল ডিএসই।

আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা ব্লুমবার্গের ২০২০ সালে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সূচক সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ। বিদায়ী বছর শেষে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচকটি দাঁড়ায় ৫৪০২ পয়েন্টে। আর গতকালের উত্থানের পর সূচকটি ৫৬১৮ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
ব্লুমবার্গের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী বছরে অধিকাংশ দেশের পুঁজিবাজার ভালো অবস্থায় ছিল। এর মধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতের বাজারের প্রধান সূচক এসএন্ডপি বিএসই বেড়েছে ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। পাকিস্তানের কেএসই অল শেয়ার-এর সূচক ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ, ভিয়েতনামের হো চি মিনাহ স্টক ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কার সিএসই অল শেয়ার-এর সূচক বেড়েছে ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ।

পুঁজিবাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বাণিজ্য অনুষদের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা বলেন, করোনার টিকা, লটারি ছাড়া আইপিওসহ বেশকিছু ইতিবাচক খবর রয়েছে পুঁজিবাজারের উত্থান ও লেনদেনের নেপথ্যে। তাছাড়া এখনোও অনেক শেয়ার আন্ডার ভ্যালু রয়েছে। আর যেসব শেয়ারের দর বাড়ছে, তার অধিকাংশই উৎপাদনমুখী কোম্পানি। এসব কোম্পানির বেশিরভাগেরই পিই রেশিও এখনো বিনিয়োগ অনুকূল অবস্থায় রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সম্প্রতি বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে সারা দেশে ব্রোকার হাউজ শাখা খোলার অনুমতি, দেশে বিদেশে বুথ সম্প্রসারণ এবং সর্বশেষ সবার জন্য আইপিও বণ্টন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য। এসব পদক্ষেপ স্বল্প মেয়াদে বাহ্বা পাওয়ার জন্য নিলে হবে না। পরিকল্পনা করতে হবে দীর্ঘ মেয়াদে। তা হলেই পুঁজিবাজারমুখী হবেন বিনিয়োগকারীরা।

ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পুঁজিবাজারমুখী সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আশার আলো জাগছে। আগের কমিশনের তুলনায় বর্তমানের কমিশন কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ার ধারণসহ রবি, ওয়ালটনের মতো ব্র্যান্ডভ্যালুর কোম্পানি তালিকাভুক্ত করায় চাঙ্গাভাব তৈরি হয়েছে। তবে এই ধারা ধরে রাখতে হলে সরকারি-বেসরকারি ভালো কোম্পানির আইপিও আনতে হবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের জন্য যৌক্তিক দামে শেয়ার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

এ বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সবার কার্যকর উদ্যোগে পুঁজিবাজার এগিয়ে চলছে। আমরা আশা করছি উত্থানের গতি অব্যাহত থাকবে। ভালো ভালো আইপিও আনছি, বন্ড নিয়ে আসছি। আগামী ছয় মাসের মধ্যে যখন সরকারের ট্রেজারি বন্ড, সুকুকের লেনদেন শুরু হবে, তখন লেনদেনের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে। যেহেতু ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ ততটা লোড নিতে পারবে না, তাই তাদেরও তথ্য-প্রযুক্তিতে সক্ষমতা বাড়াতে হচ্ছে।

আইপিও প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগামী দুই-তিন মাসে ওমেরা, বারাকা পতেঙ্গা, অ্যাকমি পেস্ট্রিসাইজসহ কয়েকটি ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্স পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে। এছাড়া আমরা শুনেছি, ওষুধ খাতের কোম্পানি ইনসেপ্টাও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা আশা করছি, এসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে পুঁজিবাজারের গভীরতা আরও বাড়বে।