দেশ প্রতিক্ষণ, নোয়াখালী: ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই তিনি। টানা তিন বারের পৌর চেয়ারম্যান। এলাকায় জনপ্রিয়তাও প্রশ্নাতীত। তবু সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে তিনি রাজপথে। নাম আবদুল কাদের মির্জা। রোববার দিনভর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভায় তার অনুসারীরা করেছে বিক্ষোভ। সড়কে আগুন ধরিয়ে করা হয়েছে অবরোধ। মির্জা নিজেও অংশ নিয়েছেন সেই কর্মসূচিতে।

সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন করে না বলে বিএনপি যে অভিযোগ করে আসছে, তার মধ্যে অভিযোগের মধ্যে এই ঘটনাটি বিরোধী দলটির নেতাদেরকে বক্তব্য দানে সুযোগ করে দিয়েছে।

সোমবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, তারা যে অভিযোগ করে আসছিলেন, তার প্রমাণ করে দিয়েছেন ওবায়দুল কাদেরের ভাই নিজেই। এই অবস্থায় নোয়াখালী তো বটেই, বিষয়টি ব্যাপক আলোচনা তৈরি করেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। প্রশ্ন উঠেছে যেখানে নির্বাচন মানেই আওয়ামী লীগের জয়জয়কার, সেখানে এমন কী প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে, যাতে খোদ ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের ভাইকে আন্দোলনে নামতে হয়েছে?

বিস্ময়কর হলো, যে এলাকায় ভোট নিয়ে এই হট্টগোল, সেখানে কাদেরের ভাই মির্জার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী কামাল উদ্দিন চৌধুরী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোশাররফ হোসাইনের ভোটের পরিবেশ নিয়ে আপত্তি তো নেইই, বরং বাংলাদেশে বিরোধীদের মধ্যে যে ঢালাও অভিযোগের প্রবণতা আছে, তার বিপরীতে গিয়ে তারা বলছেন, এলাকায় নির্বাচনের পরিবেশ ভালো আছে।

রোববার দুপুর থেকে বসুরহাট মুজিব চত্বরে কাদের মির্জার অনুসারীরা নির্বাচনি প্রতীক নৌকার শ্লোগান ছেড়ে জেলা প্রশাসকের অপসারণ, সুষ্ঠ নির্বাচন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যের বিচারের দাবিতে সড়ক অবরোধ ও অবস্থান ধর্মঘট করে। কাদের মির্জা এমনও বলেন, বৃহত্তর নোয়াখালীতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দলের চার থেকে পাঁচ জন সংসদ সদস্য ছাড়া বাকিরা ঘর থেকেই বের হতে পারবেন না।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে বৃহত্তর নোয়াখালীর সবগুলো আসন পেয়েছে ক্ষমতাসীন জোট। তবে ভোট নিয়ে আপত্তি তুলেছে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি জোট। তাদের অভিযোগ, কেন্দ্র দখল করে সিল মেরে আওয়ামী লীগ আসনগুলো দখল করেছে।

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সারা দেশে ভূমিধস জয় পেলেও বৃহত্তর নোয়াখালীতে খুব একটা ভালো করতে পারেনি। ওই বছর নোয়াখালীর ছয়টি আসনের মধ্যে নৌকা মার্কার প্রার্থীরা জিতেন দুটি আসনে। লক্ষ্মীপুরের চারটি আসনের মধ্যে তিনটিতে জিতে ধানের শীষের প্রার্থীরা। ফেনীর তিনটি আসনের সবগুলোতেই বড় ব্যবধানে হেরে যায় আওয়ামী লীগ।

আবদুল কাদের মির্জা নির্বাচন ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী লালন, ছোট পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় অংকের ঘুষ, টেন্ডারবাজির অভিযোগ এনেছেন।

বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী কামাল উদ্দিন চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রার্থী কেন সুষ্ঠু নির্বাচন দাবিতে এভাবে মাঠে নামলেন, সেটা গভীর চিন্তার বিষয়। কারণ, নির্বাচনী পরিবেশ এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক আছে। আমি এখনও গণসংযোগে আছি। ভোটারদের যথেষ্ট সাড়া পাচ্ছি। কোনো ধরনের কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।’

জামায়াতের রাজনীতিতে জড়িত স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহাম্মদ মোশাররফ হোসাইনও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সবই ভালো আছে। তবে বিগত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারে নাই, এ নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে কি না সেই আশঙ্কায় আছি।’’

বিরোধীদের যেখানে অভিযোগ নেই, সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কেন আন্দোলনে?- জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম বলেন, ‘একজন প্রার্থী হিসেবে আবদুল কাদের মির্জার অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন দাবি করাটা স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র এবং ভোটের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই এ দেশের মানুষ গণতন্ত্র এবং ভোটের অধিকার ফিরে পেয়েছে। আমরা চাই জনগণ তাদের স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগ করুক।’

আগের দিন আন্দোলন করলেও সোমবার দিনভর প্রচার চালিয়েছেন কাদের মির্জা। দ্বিতীয় দিন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা আগের দিনের আন্দোলনের প্রসঙ্গে কোনো কথাও তোলেননি। এ বিষয়ে কাদের মির্জার সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

কাদের মির্জার যত অভিযোগ:  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, আবদুল কাদের মির্জা অভিযোগ তুলে বলেন, পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে অস্ত্র এসেছে এখানে, কাউন্সিলরদের টাকা দেয়া হয়েছে নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর জন্য। এসবের প্রতিবাদে রোববার দুপুর থেকে সড়ক অবরোধ করে জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ চলতে থাকে। এক পর্যায়ে কাদের মির্জা বিক্ষোভকারীদের নিয়ে সড়কে শুয়ে পড়লে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

সেদিন সকালে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে নির্বাচনী আচরণবিধি সংক্রান্ত সভা চলছিল। এ সময় কাদের মির্জা নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী, ফেনীর সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী ও সন্দ্বীপের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনেন। দলীয় বিভিন্ন বিষয়েও তিনি বক্তব্য দিতে থাকেন।

তখন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম তাকে নির্বাচন ও আচরণবিধি মেনে কথা বলার জন্যে অনুরোধ জানান। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে মেয়র প্রার্থী আবদুল কাদের মির্জা সভাস্থল ত্যাগ করেন। তার অনুসারীরা জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দিতে থাকেন। পরে বিক্ষোভকারীরা বসুরহাট জিরো পয়েন্টে বঙ্গবন্ধু চত্বরে জড়ো হন। সেখানে কাদের মির্জা অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষোভ আরও জোরাল হয়। সন্ধ্যার পর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম বিক্ষোভস্থলে যান।

পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন বলেন, বিষয়টি তাদের জন্য বিব্রতকর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

জেলা প্রশাসক খোরশেদ আলম খান বলেন, ‘আবদুল কাদের মির্জা নির্বাচন নিয়ে সভায় দীর্ঘক্ষণ নানা বিষয়ে বক্তব্য দেন। এক পর্যায়ে তাকে নির্বাচন ও আচরণবিধি নিয়ে কথা বলার জন্য অনুরোধ জানালে তিনি উত্তেজিত হয়ে সভাস্থল ত্যাগ করেন। এরপর তার উপস্থিতিতে অনুসারীরা প্রথমে উপজেলা পরিষদের সামনে এবং পরে প্রধান সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে।’ দ্বিতীয় ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে যে ৬১টি এলাকায় ভোট হচ্ছে, সেখানে আছে বসুরহাটও।