দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: গতিশীল পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ছে। এর মধ্যে উচ্চ মুনাফা বা লভ্যাংশের ঘোষণায় লাফিয়ে বাড়ছে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারদর। তবে এসব শেয়ারের প্রকৃত মুনাফার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন না অনেকেই। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। তাই বিভিন্ন কোম্পানির প্রকৃত মুনাফাচিত্র তুলে ধরতে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের ধারাবাহিক আয়োজন। আজ ছাপা হচ্ছে প্রথম পর্ব

ব্যাংকে টাকা রাখলে এখন বছরে সুদ বা মুনাফা পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ছয় শতাংশ। অথচ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কিছু ব্যাংক আছে, যেগুলো গত পাঁচ বছর ধরেই সঞ্চয়ের সুদের হারের চেয়ে অনেক বেশি মুনাফা দিচ্ছে। যেমন যমুনা ব্যাংক। এই ব্যাংকের শেয়ার কিনে গত পাঁচ বছরে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার মূল্যের তুলনায় সবচেয়ে কম ৯.৩৭ শতাংশ এবং সবচেয়ে বেশি ১৬.২৫ শতাংশ মুনাফা পেয়েছেন।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে একবার মুনাফা ঘোষণা করে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে অন্তর্বর্তী মুনাফাও দিতে পারে, তবে সেটির সংখ্যা খুব বেশি হয় না। আর বাংলাদেশে ব্যাংকগুলো অন্তর্বর্তী মুনাফা দেয় না। প্রতিষ্ঠানের মুনাফা হয় দুই ধরনের। বোনাস শেয়ার আকারেও তারা দিয়ে থাকে মুনাফা, আবার নগদ টাকাতেও দেয়।

যমুনা ব্যাংক ২০১৯ সালে বিনিয়োগকারীদের জন্য ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে, অর্থাৎ শেয়ার প্রতি দেড় টাকা। রেকর্ড ডেট, অর্থাৎ যে তারিখে শেয়ার থাকলে লভ্যাংশ পাওয়া যায়, সেই ১৭ জুন শেয়ারের দাম ছিল ১৬ টাকা। অর্থাৎ শেয়ার মূল্যের তুলনায় বিনিয়োগকারী এই বছরে মুনাফা পেয়েছেন ৯.৩৭ শতাংশ। শেয়ারের মূল্যের সঙ্গে তুলনা করে যে আর্থিক মুনাফা তাকে পুঁজিবাজারে বলে ইল্ড।

২০১৮ সালে এই ব্যাংকের বিনিয়োগ করে মুনাফার ইল্ড পাওয়া গেছে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকের সুদহারের প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৭ সালে এই ব্যাংকটি ২২ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়। অর্থাৎ ১০০টি শেয়ার থাকলে বিনিয়োগকারী ২২টি শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে পেয়েছেন। ফলে ওই বছর আর আর্থিক লভ্যাংশের ইল্ড হিসাবটি হবে না।

২০১৬ সালের মুনাফা ছিল বর্তমান সঞ্চয়ের সুদ হারের দ্বিগুণের চেয়ে বেশি, ১৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। ওই সময় অবশ্য ব্যাংকের সুদহার ছিল বর্তমানের চেয়ে বেশি। এই ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি মুনাফা পেয়েছেন ২০১৫ সালে। ওই বছর শেয়ারের দামের তুলনায় ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ পেয়েছেন তারা।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এমন অন্তত ১০টি ব্যাংক পাওয়া যাবে, সেগুলো বর্তমানে যে কোনো সঞ্চয়ী স্কিম, এমনকি সঞ্চয়পত্রের সুদ হারের চেয়ে বেশি হারে লভ্যাংশ ঘোষণা করে। ২০১৫ সালে এক্সিম ব্যাংকে বিনিয়োগ করে শেয়ারের মূল্যের অনুপাতে ১৩.৯৫ শতাংশ মুনাফা পেয়েছে বিনিয়োগকারীরা। ২০১৬ সালে এই হার ছিল ১২.৮২ শতাংশ। ২০১৭ সালে তা কিছুটা কমলেও বর্তমানে সঞ্চয়ী সুদহারের চেয়ে বেশি ছিল। ওই বছর মুনাফার ইল্ড ছিল ৭.২৭ শতাংশ। ২০১৮ সালে তা ছিল ৮.৪৭ শতাংশ। ২০১৯ সালে ছিল ১০ শতাংশ।

মার্কেন্টাইল ব্যাংকে বিনিয়োগকারীরা ২০১৫ সালে ১১.২১ শতাংশ মুনাফা পেয়েছেন। ২০১৬ সালে ৯.৯৩ শতাংশ ইল্ডের পাশাপাশি পাঁচ শতাংশ বোনাস শেয়ার পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ২০১৯ সালে ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার পেয়েছেন তারা। ২০১৯ সালে আবার পেয়েছেন ৮.৩৩ শতাংশ নগদ মুনাফা (ইল্ড) এবং পাঁচ শতাংশ বোনাস শেয়ার।

আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে ২০১৫ সালে ৬.৮ শতাংশ নগদের (ইল্ড) পাশাপাশি পাঁচ শতাংশ বোনাস, ২০১৬ সালে ১২.৫৮ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৬.২২ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৭.৫৪ এবং ২০১৯ সালে ৭.৫৬ শতাংশ নগদ (ইল্ড) মুনাফা পাওয়া গেছে।

সিটি ব্যাংকে ২০১৫ সালে ১০.৭৮, ২০১৬ সালে ৮.৮২, ২০১৭ সালে ৩.৫৭ শতাংশ নগদ (ইল্ড) মুনাফার পাশাপাশি পাঁচ শতাংশ বোনাস, ২০১৮ সালে ১.৯৯ শতাংশ নগদ (ইল্ড) এর পাশাপাশি পাঁচ শতাংশ বোনাস এবং ২০১৯ সালে ৭.১১ শতাংশ ইল্ড মুনাফা পাওয়া গেছে।

ইস্টার্ন ব্যাংকে ২০১৫ সালে ৬.৯৯ ইল্ড মুনাফার পাশাপাশি ১৫ শতাংশ বোনাস, ২০১৬ সালে ৬.০৯ শতাংশ ইল্ডের পাশাপাশি পাঁচ শতাংশ বোনাস, ২০১৭ সালে ৩.৯১ শতাংশ ইল্ড, ২০১৮ সালে ৫.৫৬ শতাংশ ইল্ডের পাশাপাশি পাঁচ শতাংশ বোনাস এবং ২০১৯ সালে ৪.৫২ শতাংশ ইল্ড মুনাফা পাওয়া গেছে।

এনসিসি ব্যাংকে ২০১৫ সালে ১৪.০১ শতাংশ ইল্ড মুনাফা, ২০১৬ সালে ১২.০৭ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৭.৩৪ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৩.৪৪ শতাংশ নগদ ইল্ড ও পাঁচ শতাংশ বোনাস এবং ২০১৯ সালে ১২.৫০ শতাংশ ইল্ড মুনাফা পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

ওয়ান ব্যাংকে ২০১৫ সালে ৮.১৭ শতাংশ ইল্ড মুনাফার পাশাপাশি ১২.৫ শতাংশ বোনাস, ২০১৬ সালে ৬.১ শতাংশ ইল্ডের পাশাপাশি ১০ শতাংশ বোনাস, ২০১৭ সালে ৬.২৫ শতাংশ ইল্ডের পাশাপাশি পাঁচ শতাংশ বোনাস শেয়ার পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালে ১০ শতাংশ বোনাস পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালে ৪.৮৫ শতাংশ ইল্ডের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীরা পাঁচ শতাংশ বোনাস শেয়ার পেয়েছেন।

গত পাঁচ বছর ধরে মুনাফার দিক থেকে প্রাইম ব্যাংক খুব একটা ভালো করতে পারেনি। তারপরেও শেয়ারে বিনিয়োগকারীদেরকে তারা সঞ্চয়ের সুদ হারের চেয়ে বেশি হারে মুনাফা দিতে সক্ষম হয়েছে।

২০১৫ সালে এই ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা ৮.২৯, ২০১৬ সালে ৯.০৪ শতাংশ, ২০১৭ সালে ২.৫৫ ইল্ডের সঙ্গে ১০ শতাংশ বোনাস, ২০১৮ সালে ৬.৯১ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ৭.৪২ শতাংশ ইল্ড মুনাফা পেয়েছেন।

ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবিএল) এর বিনিয়োগকারীরা ২০১৫ সালে ৯.৩৯ শতাংশ ইল্ডের পাশাপাশি পাঁচ শতাংশ বোনাস, ২০১৬ সালে ৭.০৪ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৬.৩৬ শতাংশ ইল্ড মুনাফা পেয়েছেন। ২০১৮ সালে ১০ শতাংশ বোনাস এবং ২০১৯ সালে ৩.৭৬ শতাংশ ইল্ডের পাশাপাশি পাঁচ শতাংশ বোনাস পেয়েছেন তারা।

উত্তরা ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা ২০১৫ সালে ৮.৮১, ২০১৬ সালে ৮.১০, ২০১৭ সালে ৫.৬৭, ২০১৮ সালে ৭.০২ শতাংল ইল্ডের পাশাপাশি দুই শতাংশ বোনাস এবং ২০১৯ সালে ২.৫৭ শতাংশ ইল্ডের পাশাপাশি ২৩ শতাংশ বোনাস শেয়ার পেয়েছেন।

কিছু কিছু ব্যাংক এই সময়ে কেবল বোনাস শেয়ার দিয়েছে লভ্যাংশ হিসেবে। কোনো কোনো ব্যাংক বোনাস ও নগদ মিলিয়ে লভ্যাংশ দিয়েছে। ফলে সেগুলোর কোনোটির ইল্ড হিসাব করা যায় না। আবার যেগুলো মিশ্র লভ্যাংশ দিয়েছে, সেগুলোর ইল্ড কম ছিল।

বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেডা) চেয়ারম্যান এবং মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, পুঁজিবাজারে কোনো গ্রাহক বিনিয়োগ করে আবার ব্যাংকে ডিপোজিটও রাখতে পারেন। দুটি দুই ধরনের বিনিয়োগ। একজন গ্রাহক সব সময়ই ভালোটাই চান। তার আগে গ্রাহককে মার্কেট স্টাডি ও ফান্ডামেন্টাল দেখতে হবে। এ বছর পুঁজিবাজার ভালোর দিকে রয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংকের শেয়ার ও অন্যান্য দিক ভালো আছে। যদি ব্যাংকের পাশাপাশি অন্যান্য সেক্টর একইভাবে এগিয়ে যায়, তাহলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীদের হাত পুড়বে না।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুল রহমান বলেন, ‘ব্যাংকে অর্থ রাখা হলে বছরে ৬ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে মুনাফা কিছুটা বেশি হলেও মুনাফার হিসাব হয় এক বছরে। কিন্তু পুঁজিবাজারে ক্ষেত্রে হিসাব ভিন্ন। কেউ চাইলে রেকর্ড ডেটের আগে শেয়ার কিনে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে তার বিনিয়োগের রিটার্ন পাচ্ছেন। এই হিসাবে ডিভিডেন্ট ইল্ড ১০ শতাংশ বলা হলেও সেটা আরও বেশি হবে।’

ব্যাংকের শেয়ারের দাম এখন যে পর্যায়ে আছে, সেটি খুবই লোভনীয় বলে মনে করেন এই ব্যাংকার। তিনি বলেন, ‘অনেক বিনিয়োগকারী আছেন যারা এ বিষয়টিকে যাচাই না করে স্বল্প সময়ে মুনাফার জন্য বিনিয়োগ করেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে যখন শেয়ারের দাম কমে তখন বিনিয়োগ করলে বছর শেষে তিনি অবশ্যই ভালো রিটার্ন পাবেন।’

গত ১১ মে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা এবং ব্যাংকের শেয়ারের বিনিয়োগকারীদের রিটার্নের বিষয়টি সার্বিক বিবেচনায় ২০১৯-এর সমাপ্ত বছরের জন্য ব্যাংকের শেয়ারের বিপরীতে লভ্যাংশ প্রদানের নতুন নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তখন বলা হয়, সাড়ে ১২ শতাংশ বা তারও বেশি মূলধন সংরক্ষণ করেছে এমন ব্যাংক তাদের সামর্থ্য অনুসারে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ নগদসহ ৩০ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারবে। বেশির ভাগ ব্যাংকের শেয়ারের দাম ১০ থেকে ২০ টাকার ভেতরে হওয়ায় এই নীতিমালায় নগদ মুনাফা বিনিয়োগকারীদের জন্য বেশ উপকার হতে পারে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ডিভিডেন্ড ইল্ড খুবই সহজ একটি বিষয়। কিন্তু কেউ গুরুত্ব দেন না। সবাই শুধু দেখেন কোন শেয়ারের দাম বাড়ছে, কোন শেয়ার কখন বিক্রি করলে লাভ বেশি হবে।’

তিনি বলেন, ‘ব্যাংকে যারা বিনিয়োগ করে তারা ঝুঁকিমুক্ত বিবেচনা করে বিনিযোগ করেন। কিন্তু শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সব সময় ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে বিনিয়োগ করা উচিত ফাইনান্সিয়াল জ্ঞান সম্পূর্ণ ব্যক্তিদের। কিন্ত সেটা হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকের সঙ্গে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ সমন্বয় করা কঠিন।’ পুঁজিবাজারে ফান্ডামেন্টাল কোম্পানির ইল্ড সাড়ে ৪ থেক ৫ এর মধ্যে হওয়া উচিত। এখন ব্যাংকের ইল্ড বেশি। কারণ তাদের শেয়ারের দাম কম কিন্তু এবার লভ্যাংশ দিয়েছে বেশি।