দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পোশাকখাতে শ্রমিকদের পাঁচ শতাংশ বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট সাময়িক স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মালিকেরা। করোনায় ব্যবসার মন্দার কারণে পোশাক খাত বাঁচিয়ে রাখতে তাদের এ উদ্যোগ।

বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তা কার্যকর থাকবে, যার সময়সীমা ধরা হয়েছে আগামী দুই বছর। তবে পোশাক মালিকদের এ ইচ্ছা কার্যকর করতে প্রয়োজন হবে সরকারের সম্মতি এবং শ্রমিকদের অনাপত্তি, যার কোনোটিরই সবুজ সংকেত এখনও পাওয়া যায়নি।

পোশাক মালিকেরা আশা করছেন, তারা এ পদক্ষেপে সফল হবেন। এ লক্ষ্যে পোশাক শিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিকেএমইএ ও বিজিএমইএ-এর পক্ষ থেকে গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।

এতে পোশাকখাতের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে মালিকদের পক্ষ থেকে। শ্রমিক সংগঠনগুলোকেও দেয়া হয়েছে একই চিঠি। পোশাক শিল্প মালিকেরা এখন এ বিষয়ে সরকারের সম্মতি-সহানুভূতি এবং শ্রমিকদের অনাপত্তির অপেক্ষায় রয়েছেন।

২০১৩ সাল থেকে মজুরি বোর্ড ঘোষিত বেতন কাঠামোর গেজেট অনুযায়ী প্রতিবছর পাঁচ শতাংশ হারে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর বিধান রয়েছে। সর্বশেষ ঘোষিত ২০১৮ সালের মজুরি বোর্ডের গেজেটেও সেটা বহাল আছে। ফলে আইন স্থগিত না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে মালিক পক্ষের দাবি, আগে কখনও শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্ট দেয়ার বিধান ছিল না। মালিক পক্ষের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতেই ২০১৩ সালে পাঁচ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেয়ার বিধান চালু হয়।

আইনে থাকার কারণে করোনার মধ্যেও গত বছর তারা ইনক্রিমেন্ট দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করাই যেখানে অসম্ভব, সেখানে বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট চালু রাখা কোনোভাবেই তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

চিঠিতে বলা হয়, করোনার ছোবলে সাড়া বিশ্বের অর্থনীতি পর্যদুস্ত। দেশের স্থবির অর্থনীতিতে সংকুচিত হয়ে পড়েছে কর্মক্ষেত্র। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লকডাউনে পড়ে গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে মানুষ। সেখানে পরিস্থিতি সামাল দিতে নেয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। কোথাও চলছে সাময়িক বন্ধ। কোথাও চলছে কর্মী ছাঁটাই। কোথাও বা চলছে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিভিন্ন হারে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কমিয়ে টিকে থাকার প্রচেষ্টা। প্রতিবেশী ভারতেরও শিল্পঘন বেশ কিছু রাজ্যে এখন শ্রম আইন স্থগিত রাখা হয়েছে।

চিঠিতে আরও দাবি করা হয়, পর্যাপ্ত কার্যাদেশ নেই। ধারাবাহিকভাবে কমছে রপ্তানি আদেশ। আগামীতে স্বাভাবিক কার্যাদেশ পাওয়ারও নেই নিশ্চয়তা। আবার যতটুকুর কার্যাদেশ আছে, বা রপ্তানি হচ্ছে, তারও অর্থ মিলবে ১৮০ থেকে ২০০ দিন পরে। আবার ক্রেতারা পোশাকের মূল্যও আগের তুলনায় কমিয়ে দিয়েছে ১০-১৫ শতাংশ হারে। এখানে কোনো দর কষাকষিরও সুযোগ থাকছে না।

এ পরিস্থিতিতে শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মসংস্থান বজায় রাখার স্বার্থে মালিকেরা লোকসান দিয়ে কার্যাদেশ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। কাঁচামালের বাজারেও চলছে অনিশ্চয়তা। হঠাৎ করে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের নিশ্চিত করা ক্রয়াদেশের রপ্তানি বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়েছে। এখানে আরেক দফা বিশাল অংকের লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘করোনার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির গতির সংকোচন হয়েছে ব্যাপক হারে। এর ফলে সারাবিশ্বে যখন কর্মী ছাঁটাই, বেতন সংকোচন, এমনকি কোথাও কোথাও পুরো প্রতিষ্ঠানই বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, সেখানে আমরা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাময়িক সময়ের জন্য শুধুমাত্র শ্রমিকদের বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট স্থগিত রাখার আবেদন করেছি। কারণ করোনার দ্বিতীয় প্রকোপে দেশের পোশাকখাতের সার্বিক ভবিষ্যতই এখন অস্তিত্ব সংকটের মুখে।’

এই কঠিন পরিস্থিতিতে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে বেতন বাড়ানোর আইনি সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার কোনো বিকল্প নেই দাবি করে তিনি বলেন, ‘শিল্পই যদি না বাঁচে, তবে শ্রমিকদের কী হবে, উদ্যোক্তাদের কী হবে?’

তিনি বলেন, ‘উদ্যোক্তা ও শ্রমিক উভয়ের স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্যই এই শিল্পকে সবার আগে বাঁচিয়ে রাখতে সব পক্ষের প্রচেষ্টা থাকা উচিত।’

তিনি শ্রমিক নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা না করে, আসুন বাস্তবতা বুঝে বেতন বাড়ানোর এই বিধানটি আপাতত স্থগিত রাখার সুপারিশ করি।’ তবে মালিকদের এই সিদ্ধান্তে শ্রমিক নেতারা দ্বিমত পোষণ করেছেন। বাংলাদেশ গার্মেন্ট সংহতির আহ্বায়ক ও গার্মেন্ট শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য তাসলিমা আখতার লিমা এটিকে ‘অনৈতিক আবদার’ বলে অভিহিত করেন।

তিনি বলেন, ‘সরকার সব সময়ই মালিকদের নীতি সহায়তা দিয়ে আসছে। করোনা পরিস্থিতিতেও নীতি সহায়তা দিয়েছে। আবারও প্রণোদনা দেয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এরপরও কেন এই আবদার?’

তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতেও শ্রমিকেরা জীবন বাজি রেখে শ্রম দিয়ে মালিকের ব্যবসা সচল রাখছে। দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। এখন অজুহাত দেখিয়ে মালিকেরা চাইলেই শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার খর্ব করতে পারবেন না। তারা নিজেরা ইচ্ছা পোষণ করলেই তো আর হলো না। এর জন্য আইন, সরকার এবং শ্রমিকদের সম্মতি দরকার।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যদি এ ধরনের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয় তাহলে শ্রমিকরা তাদের অধিকার ফিরে পেতে আন্দোলনের মাধ্যমেই তার সমুচিত জবাব দেবে।’

এ বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আব্দুস সালাম বলেন, ‘শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্টের ধারাবাহিকতা স্থগিত রাখার ইস্যুটি একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। এর সঙ্গে আইনি দিক জড়িত। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত জড়িত। পোশাক শিল্প মালিকদের প্রস্তাবটি এখনও প্রস্তাব আকারে আছে। সরকার এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

‘তবে যেহেতু ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ, এখানে পক্ষ-বিপক্ষ রয়েছে। তাই সরকারকেই এখানে ভূমিকা রাখতে হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেয়ার আগে সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’