এফ জাহান ও আবদুর রাজ্জাক, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে উত্থান-পতন একটি স্বাভাবিক নিয়ম। তবে একটানা উত্থান যেমন ভাল লক্ষণ নয়, তেমনি একটানা দরপতন স্থিতিশীল বাজারের লক্ষণ নয়। পুঁজিবাজারকে উঠানামা মধ্যে স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। তেমনি দীর্ঘদিন পর ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে দেশের পুঁজিবাজার, যার জের ধরে বাড়ছে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর।

পাশাপাশি বাজার মূলধন ও সূচক ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে। বাড়ছে লেনদেনও। নিয়মিত লেনদেন ছাড়িয়েছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। এক মাস ধরে ডিএসইতে নিয়মিত এক হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হতে দেখা যাচ্ছে। ২০১০ সালের পর এমনটি আর দেখা যায়নি। এদিকে বাজার ভালো থাকায় প্রত্যাশা বাড়ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। তারা আশা করছে এই ধারাবাহিকতা দীর্ঘমেয়াদিভাবে স্থায়ী ও স্থিতিশীল হয়।

এদিকে বাজার পরিস্থিতি ভালো থাকায় স¤প্রতি ডিএসইর বাজার মূলধন পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ১৪ জানুয়ারি ডিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটের বাজার মূলধন দাঁড়ায় পাঁচ লাখ এক হাজার কোটি টাকা। পরে তালিকাভুক্ত গ্রামীণফোন, রবি আজিয়াটাসহ কিছু শীর্ষ বাজার মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদর কমে যায়।

ফলে বাজার মূলধন পাঁচ লাখ কোটি টাকার নিচে নেমে গেছে। গতকাল ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। এক মাস আগে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল চার লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে বাজার মূলধন বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। এদিকে নতুন বছরের প্রথম দুই সপ্তাহ উত্থান হলেও তৃতীয় সপ্তাহের বাজার বিশ্লেষন শেষে দেখা গেছে পতন হয়েছে পুঁজিবাজারে।

সপ্তাহটিতে শেয়ারবাজারের সব সূচক কমেছে। একই সাথে কমেছে লেনদেনে অংশ নেয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দর এবং টাকার পরিমাণে লেনদেন। আর সপ্তাহটিতে বৃহৎ শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বিনিয়োগকারীরা ৯ হাজার কোটি টাকা বাজার মূলধন হারিয়েছে।
জানা গেছে, সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস লেনদেন শুরুর আগে ডিএসইতে বাজার মূলধন ছিল ৫ লাখ ১ হাজার ৭০৯ কোটি ৬৪ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। আর সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস লেনদেন শেষে বাজার মূলধন দাঁড়ায় ৪ লাখ ৯২ হাজার ২৮৯ কোটি ৫ লাখ ২১ হাজার টাকায়।

অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইর বিনিয়োগকারীরা ৯ হাজার ৪২০ কোটি ৫৯ লাখ ৫৯ হাজার টাকা বাজার মূলধন কমেছে। বিদায়ী সপ্তাহে পাঁচ কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ৭ হাজার ৮২৪ কোটি ৮৭ লাখ ৪২ হাজার ৪৪৯ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের সপ্তাহ থেকে ১ হাজার ৫১৮ কোটি ৪২ লাখ ৪ হাজার ৪৭২ টাকা বা ১৬.২৫ শতাংশ কম হয়েছে। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ৯ হাজার ৩৪৩ কোটি ২৯ লাখ ৪৬ হাজার ৯২১ টাকার।

ডিএসইতে বিদায়ী সপ্তাহে গড় লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৫৬৪ কোটি ৯৭ লাখ ৪৮ হাজার ৪৯০ টাকার। আগের সপ্তাহে গড় লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৮৬৮ কোটি ৬৫ লাখ ৮৯ হাজার ৩৮৪ টাকার। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইতে গড় লেনদেন ৩০৩ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৪ টাকা কম হয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৭৩.১২ পয়েন্ট বা ১.২৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮৩৬.১৮ পয়েন্টে।

অপর সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক ২৮.৮৬ পয়েন্ট বা ২.১৮ শতাংশ এবং ডিএসই-৩০ সূচক ২৮.৩৩ পয়েন্ট বা ১.২৭ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১২৯৪.৬৫ পয়েন্টে এবং ২২০৮.৪৫ পয়েন্টে। বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইতে মোট ৩৬৪টি প্রতিষ্ঠান শেয়ার ও ইউনিট লেনদেনে অংশ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে ৮৪টির বা ২৩.০৭ শতাংশের, কমেছে ২২৯টির বা ৬২.৯২ শতাংশের এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৫১টির বা ১৪.০১ শতাংশের শেয়ার ও ইউনিট দর।

তাছাড়া দীর্ঘদিনের মন্দাভাব কাটিয়ে চাঙ্গাভাব ফিরলেও পুঁজিবাজার নিয়ে আবার ভয় ধরতে শুরু করেছে বিশেষজ্ঞসহ অনেক বিনিয়োগকারীর মনে। আগের মতোই কারসাজিকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নামে- বেনামে নানা পেজ খুলে ‘গুজব’ ছড়িয়ে দুর্বল মৌল ভিত্তি শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে চলেছে তারা। এভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে মুনাফা। মৌল ভিত্তিহীন এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে ঝুঁকিতে পড়ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানা কঠোরতার মধ্যেও কারসাজিকারী চক্রটির তৎপরতা বাড়ছে।

সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নানা পদক্ষেপে পুঁজিবাজারবিমুখ ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কয়েক মাস ধরে পুঁজিবাজারে ফিরতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সূচক ও লেনদেন বাড়ছে। ২০১০ সালের ধসে পুঁজি খোয়ানো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আবার আশায় বুক বেঁধেছেন। কিন্তু সেই আশায় বাদ সাধছে কারসাজিচক্র। এ রকম পরিস্থিতিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যাতে ফের বিপদে না পড়েন সে জন্য তাঁদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

তাঁরা বলছেন, অতিরিক্ত মুনাফার আশায় তাঁদের দুর্বল মৌল ভিত্তির শেয়ারে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। এতে মুনাফার বদলে উল্টো লোকসানের ফাঁদে পড়ার প্রবল ঝুঁকি থাকে। যারা মন্দ শেয়ার নিয়ে খেলছে, তাদের ব্যাপারে বিএসইসিকে আরো কঠোর হওয়ার দাবি জানিয়েছেন বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজার কিছুটা মূল্য সংশোধন হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের মুনাফা তুলে নেওয়ার প্রবণতায় ‘বিক্রির চাপ’ বেশি থাকায় পুঁজিবাজারে কিছুটা সংশোধন হচ্ছে বলে মনে করছেন তাঁরা। তবে শিগগিরই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। কয়েক দিনের টানা উত্থানে কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। সেই সঙ্গে দুর্বল কেম্পানির শেয়ারের দামও বেড়েছে। এখন সেই কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দরপতন হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে শেয়ারবাজারে। তাই অতিরিক্ত লোভে পড়ে কোনো অবস্থায়ই দুর্বল শেয়ারে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওসমান ইমাম বলেন, ‘শেয়ারবাজারে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ হচ্ছে কম। ডে ট্রেডাররা বেশি সক্রিয়। গুজব নির্ভর বাজারের গতি-প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে গ্যাম্বলিং হচ্ছে। বিএসইসি তদন্তের সার্কুলার দিয়ে তা স্থগিত করেছে। এই ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সার্ভেইল্যান্স জোরদার করতে হবে, আরো কঠোর হতে হবে।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হলে একটি কোম্পানির কমপক্ষে পাঁচ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। বিনিয়োগকারীরা যদি কোম্পানিগুলো সম্পর্কে জেনেশুনে বিনিয়োগ করে তাহলে লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা কম।’ তবে নতুন কমিশনের কিছু সিদ্ধান্তের ফলে পুঁজিবাজারে সুশাসন ফিরেছে। একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার গড়ে তুলতে হলে বিনিয়োগকারীদের শিক্ষিত হতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শেয়ারের দাম কমে গেলে বাজার মূলধন কমে গিয়েছিল। তেমনি শেয়ারের দাম বাড়ায় বাজার মূলধন বেড়েছে। এটি স্বাভাবিক ঘটনা। তবে করোনাকালে সূচকের টানা উত্থান নতুন কমিশনের শক্তিশালী পদক্ষেপ কারণে হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয় জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় পুঁজিবাজার পিছিয়ে ছিল। এখন পুঁজিবাজার ভালো হচ্ছে, এটা টেকসই করাটাই চ্যালেঞ্জ। যত বেশি ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হবে, পুঁজিবাজারের গভীরতা তত বাড়বে। বাজারে শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে বিএসইসি যথেষ্ট তৎপর আছে। বিনিয়োগকারীদের গুজবে কান না দিয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে ঋণ নিয়ে শেয়ার না কেনার।’

সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে কারসাজিকারী চক্রকে হুঁশিয়ার করে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম বলেছেন, ‘পুঁজিবাজারে কারসাজি করে এখন আর কেউ পার পাবে না। পুঁজিবাজারে কোনো লোক যদি দুষ্টামি করতে আসে, তার কাছে কত টাকা থাকতে পারে? শত কোটি, হাজার কোটি? আমরা তার ১০ গুণ ক্ষমতা দিয়ে দিচ্ছি আইসিবিকে, যাতে কেউ খেলতে এসে কোনো সুবিধা না করতে পারে। কেউ খেলতে চাইলে আমরা তাকে ধরে ফেলব তখনই।’

নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান আরো বলেছেন, ‘১৯৯৬ সালে এবং ২০১০ সালে যে ধস হয়েছে, সে সময় আজকের মতো পুঁজিবাজার নিয়ে সবার জ্ঞান ছিল না। ১৯৯৬ সালে মানুষ হাতে কাগজ নিয়ে মতিঝিলে শেয়ার লেনদেন করত। কিন্তু এখন এ রকম নেই। এখন এগুলো সব চলে এসেছে সিসিবিএল, সিডিবিএল এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের আইটি প্ল্যাটফর্মের মধ্যে। আমাদের সার্ভেইল্যান্সের সফটওয়্যার এখন অনেক শক্তিশালী। আমরা সুইডেনের এখন সবচেয়ে লেটেস্ট যে সার্ভেইল্যান্সের সফটওয়্যার, সেটা ব্যবহার করছি। যে কেউ কোনো কিছু করলেই আমরা সহজেই সেটা ধরে ফেলতে পারি।’