এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে টানা পাঁচ কার্যদিবস ধরে কমছে লেনদেন। সূচকের উত্থান-পতনের মধ্যে লেনদেন কমে আসায় প্রশ্ন উঠেছে এটি কি মূল্য সংশোধন, নাকি ধারাবাহিক দরপতন এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মাঝে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাছাড়া মুনাফা তুলে নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়া বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ছেড়ে দেওয়ার প্রভাবে পুঁজিবাজারে বড় দরপতন হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। তবে বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে কিছুটা বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। বাজারের এ পরিস্থিতির জন্য একের পর এক আইপিও আসাকে দায়ী করছেন।

এদিকে বেক্সিমকোর ১ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার ১৫৬টি শেয়ার ৯ হাজার ৩৫৯ বার হাত বদল হয়েছে। এর মাধ্যমে কোম্পানিটির ১৪০ কোটি ১৮ লাখ ৩৮ হাজার টাকার লেনদেন হয়েছে। ডিএসইতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থাৎ ৫৪ কোটি ৪১ লাখ ৮২ হাজার টাকার বৃটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ ৪০ কোটি ৫৩ লাখ ৯৩ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে শেয়ারের মূল্য সংশোধন হচ্ছে। তবে লেনদেন কমা নিয়ে তাদের মধ্যে আছে মিশ্র ভাবনা। আর সংশোধন এত দীর্ঘায়িত হচ্ছে কেন, এমন প্রশ্ন করছেন বিনিয়োগকারীরা। টানা পাঁচ কার্যদিবস ধরে কেবল শেয়ারমূল্য ও সূচক কমছে না, টানা কমছে লেনদেন। এটা ভাবার বিষয় বলে মনে করেন তারা।

এদিকে সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবস সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ডিএসই লেনদেন হয়েছে ৭১৭ কোটি টাকা। এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর ডিএসইতে লেনদনে হয়েছিল ৭১৯ কোটি টাকা। এরপর আর এত কম লেনদেন হয়নি। গত ২১ ডিসেম্বর থেকে টানা এক মাসেরও বেশি ধরে পুঁজিবাজারে লেনদেন হয়েছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। পাঁচ দিন লেনদেন হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। কিন্তু গত চার কার্যদিবস ধরে আবার এক হাজার কোটি টাকার নিচে নেমেছে লেনদেন। তা-ও প্রতিদিনই কমছে।

লেনেদেনের পাশাপাশি কমছে শেয়ারমূল্য, সূচক, বাজার মূলধন। গত এক দশক ধরে আস্থাহীনতার যে কথা বারবার বলা হচ্ছিল, সেটি নিয়ে আবার উৎকণ্ঠিত বিনিয়োগকারীরা। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে মূলত উত্থান শুরু হয়ে পুঁজিবাজারে। বাড়তে থাকে সূচক ও লেনদেন। ধরাবাহিক হাজার কোটি টাকার লেনদেন সর্বোচ্চ উঠে আড়াই হাজার কোটি টাকায়। লেনদেনের উত্থানে আলোচনায় আসে তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানির বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা ও রবি।

টেলিকমিউনিকেশন খাতের নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে রবির প্রতি আগ্রহ ছিল বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বেশি। কিন্তু দেশের করোনা টিকা দেশে আনার ক্ষেত্রে বেক্সিমকো গ্রুপের সম্পৃক্ততার কারণে আগ্রহের শীর্ষে চলে আসে বেক্সিমকো ফার্মাও। সর্বশেষ আর্থিক বিবরণীতেও বেক্সিমকো লিমিটেডের আয়ের ইতিবাচক প্রভাব বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কিনতে বাড়তি আগ্রহ যোগ করে।

ফলে ডিসেম্বরে যে কোম্পানির শেয়ারের দর ছিল ২৩ টাকা তা বেড়ে উঠেছে ৯০ টাকায়। একই সঙ্গে ডিসেম্বরে তালিকাভুক্ত হয়ে ১০ টাকার রবির শেয়ার মাত্র ১৬ কার্যদিবসে দর বেড়ে হয় ৭১ টাকা। এরপর থেকেই শুরু হয় মূল্য পতন। রবির শেয়ারের দর এখন ৫১ টাকায়। যদিও বেক্সিমকো সেই তুলনায় দর ধরে রেখেছে অনেকটাই।

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী কাজী হোসাইন আলী বলেন, ‘পুঁজিবাজার ভালো হচ্ছিল দেখে আশান্বিত হয়েছিলাম। নতুন করে বিনিয়োগও করা হয়েছে। কিন্ত এখন যেভাবে লেনদেনসহ শেয়ারের দর কমেছে, তাতে আতঙ্কিত যে বিনিয়োগ সঠিকভাবে ফেরত পাব কি না। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা পুঁজিবাজার ভালো করার জন্য যেমন বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করে, তেমনি যখন ক্রমাগত লেনদেন কমতে থাকে তখনো নজরদারি করা উচিত। এবং সে সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের অবগত করা উচিত। তাহলেই পুঁজিবাজার থেকে আস্থাহীনতা দূর হবে।’

দরপতনের কারণ ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাধারণ সম্পাদক রিয়াদ মতিন বলেন, বিনিয়োগকারীরা তাদের মুনাফা তুলে নিয়েছে। সবাই মুনাফা তুলতে চাওয়ায় বিক্রির চাপে সূচক কমে গেছে। এছাড়া গত দুই তিন মাসে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সূচক অনেক বেড়েছে। টানা সূচক বাড়তে পারে না। কিছুটা মূল্য সংশোধন হতে হয়। আজকের পতনটা সংশোধনের একটা অংশ। কিছু কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম সম্প্রতি যেভাবে আকাশচুম্বী হয়ে গিয়েছিল, সেই প্রেক্ষিতে দরপতনের মাধ্যমে এই মূল্য সংশোধনকে কাঙ্খিত হিসেবেই দেখছেন বিএমএসএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, ‘যে ভাবে পুঁজিবাজারের উত্থান হয়েছে তাতে মূল্য সংশোধন জরুরি ছিল। কিন্ত লেনদেন যেভাবে কমে আসছে তাতে সন্দেহ হচ্ছে, বাজার থেকে কেউ টাকা নিয়ে যাচ্ছে কি না।’ আগের দিন ৭৪ পয়েন্টের পর সোমবার সূচক পড়েছে ৫০ পয়েন্ট, কমেছে লেনদেন, উদ্বেগে বিনিয়োগকারীরা তিনি বলেন, ‘রবির শেয়ারের দর যে পর্যায়ে পৌছেছিল তাতে এর মূল্য সংশোধন প্রয়োজন ছিল। আর হচ্ছেও। আর বেক্সিমকোর শেয়ারের দর অতিমূল্যায়িত হয়েছে। পাশাপাশি অনেক কোম্পানির শেয়ারের দরও অস্বাভাবিকভাবে কমে এসেছে। ফলে হঠাৎ করে কেন লেনদেনের কমে আসছে, সেটিও নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুসন্ধান করা উচিত বলে মনে করেন আবু আহমেদ।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘দুই হাজার কোটি টাকা যখন পুঁজিবাজারে লেনদনে হয় তখন স্বাভাবিকভাবে বলা যায়, এখানে নতুন বিনিয়োগ হয়েছে। ফলে যারা বিনিয়োগ করছেন, তারা মুনাফা করবে। মূলত মুনাফা উত্তোলনের কারণেই শেয়ারের দর কমছে।’

তিনি বলেন, ‘দুই হাজারে কোটি টাকা থেকে এক দিনেই কিন্ত সাতশ কোটি টাকা হয়নি। লেনদেন কমেছে ধাপে ধাপে। ফলে এখানে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এ সময়ে যেসব কোম্পানির শেয়ারের দর অতিমূল্যায়িত হয়েছে, এখন সেগুলোর দর কমেছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা আগের তুলনায় অনেক সক্রিয়।’

জানুয়ারি মাসের শেষ কার্যদিবস রবিবারের মতো ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম কার্যদিবস সোমবারও (০১ ফেব্রুয়ারি) বড় পতনে শেষ হয়েছে শেয়ারবাজারের লেনদেন। এদিন উভয় শেয়ারবাজারের সব সূচক কমেছে। একইসঙ্গে কমেছে লেনদেনে অংশ নেয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর এবং টাকার পরিমাণে লেনদেনও। আজ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আবার ৫ হাজার ৬০০ পয়েন্টের নিচে নেমেছে।

জানা গেছে, আজ প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ৭১৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। যা আগের দিন থেকে ১০৫ কোটি ১০ লাখ টাকা কম। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৮২৩ কোটি ১০ লাখ টাকার। আজ ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫০.০৬ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫৯৯.৮০ পয়েন্টে। ডিএসইর এই সূচকটি এক মাস এক দিন বা ২১ কার্যদিবস পর ৫ হাজার ৬০০ পয়েন্টের নিচে নেমেছে।

এর আগে বিদায়ী বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই সূচকটি ৫ হাজার ৪০২ পয়েন্টে অবস্থান করছিল। ডিএসইর অপর সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক ১১.২৩ পয়েন্ট, ডিএসই-৩০ সূচক ৩৪.৯০ পয়েন্ট এবং সিডিএসইটি ১৮.৬৭ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১২৫৪.১৩ পয়েন্টে, ২১২৫.৪৮ পয়েন্ট এবং ১১৯৮.৭৪ পয়েন্টে।

ডিএসইতে আজ ৩৫৬টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ১১০টির বা ৩০.৮৯ শতাংশের, শেয়ার দর কমেছে ১৩৮টির বা ৩৮.৭৬ শতাংশের এবং ১০৮টির বা ৩০.৩৩ শতাংশের শেয়ার ও ইউনিট দর অপরিবর্তিত রয়েছে।

অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১৭৮.১৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ২৯৬.৮২ পয়েন্টে। সিএসইতে আজ ২৩৪টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬৮টির দর বেড়েছে, কমেছে ১১১টির আর ৫৫টির দর অপরিবর্তিত রয়েছে। সিএসইতে ২৭ কোটি ৫৫৯ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।