দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের যেসব উদ্যোক্তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ খেলাপি হচ্ছেন তারাই ঘুরে ফিরে আবার নতুন করে ঋণ পাচ্ছে। অর্থাৎ দেশের ব্যাংকগুলো তেলের মাথায় তেল দিচ্ছে। অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান থাকলেও ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন তারাই। করোনার সংকট কাটিয়ে নতুন করে শুরু করার চেষ্টা করলেও নগদ অর্থের সংকটে এগোতে পারছে না ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরেও মিলছেনা কাক্সিক্ষত ঋণ সহায়তা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন ব্যাংকগুলোর কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে দেশের ছোট ব্যবসায়ীরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বড় ব্যবসায়ীরা ১০০ টাকা থেকে গড়ে ৬৮ টাকা পেয়েছেন। অথচ ছোট ব্যবসায়ীদের দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৬ টাকা। শুধু তাই নয়, প্রণোদনা প্যাকেজ হতে যেখানে এক হাজার ৭৮৬ জন বড় ব্যবসায়ীকে দেওয়া হয়েছে ২৩ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা, সেখানে ৯ হাজার ৫০ জন এসএমই খাতের উদ্যোক্তাকে দেওয়া হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৫২২ কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিকে অনেকে বলছেন, আসলে তেলে মাথায় তেল দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।

একদিকে সরকার বলছে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে কর্ম সংস্থানের সুযোগ তৈরি কথা। অপরদিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন সময়ই নেই তাদের দিকে তাকানোর। সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি হয়েছে অনেক নতুন উদ্যোক্তা তবে মূলধনের অভাবে সামনে যেতে পারছে না তারা। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারা জানান, জামানতসহ নানা অজুহাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দিতে চায় না। মূলত ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সারা দেশের গ্রামীণ নারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অভিযোগ একই রকম।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বড়দের টাকা দেওয়ার ব্যাপারে সব সময়ই ব্যাংকগুলো আগ্রহী থাকে। এর সুফলও পাচ্ছে পোশাক খাত। তবে অবহেলায় থাকে ক্ষুদ্র ও মাঝারিরা। যদিও ক্ষুদ্র ও মাঝারিরাই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।’

প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলেও তার বাস্তবায়ন খুবই কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে আলাদা তহবিল করে অর্থ পৌঁছাতে হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) উদ্যোক্তাদের জন্য।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে বেশ কিছু উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে এখাতের এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা মধ্যে ইসরাত জাহান চৌধুরীরও একজন। তিনি একসময় ছিলেন ব্যাংকার, তবে বড় কিছু করার বাসনা থেকে চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হয়ে উঠার চেষ্টা করছেন। নিজের হাতে দাঁড় করানো প্রতিষ্ঠান ‘তুলিকা’কে নিয়ে এখন অর্থ সংকটে তিনি। খরচ অব্যাহত রয়েছে তবে হাতে নেই অর্ডার। ধরণা দিয়েও মিলছেনা ঋণ সহায়তা।

ইসরাত জাহান চৌধুরী জানান, শুধু মুখেই বলা হচ্ছে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। আসলে বাস্তবে তা ঠিক উল্টো। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বাঁচাতে ঋণ সহজীকরণের আহ্বান তার। অন্য এক মাঝারি উদ্যোক্তা সাজেদুর রহমান, নিজের প্রতিষ্ঠান কেপিসিতে তৈরি করছেন ওয়ান টাইম পেপার কাপ। করোনা মহামারিতে তার পণ্যের চাহিদা বাড়লেও সস্তায় বিদেশি পণ্যের দাপটে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়েছে তার।

তাছাড়া অর্থ সংকট তো রয়েছেই। যদিও ইসরাত কিংবা সাজেদুরদের মতো এসএমই উদ্যোক্তাদের নিয়ে ঠিকই ভাবছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল। তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত যার বাস্তবায়ন মাত্র ৩ হাজার ৮শ কোটি টাকা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বঞ্চিত হওয়ার প্রকৃত চিত্র উঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান কথায়।

তিনি বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে ঋণ যাচ্ছে না, কারণ ব্যাংকাররা তাদের চিনেই না এবং ব্যাংকারদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ কম বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর এই অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রায়ই নালিশ পাই, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প যেগুলো তারা যথেষ্ট পরিমাণে ঋণ পাচ্ছে না। ঘটনা সত্য। কিন্তু তারাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেশি। আমাদের যেখানে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা দরকার, যারা দারিদ্র্যের ওপর বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে; প্রণোদনা প্যাকেজ কিন্তু তাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে যাচ্ছে না।’

ড. মশিউর রহমান আরো বলেন, ‘ব্যাংকের দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। ব্যাংকের যে লোকগুলো আছে তাদের হয়তো কিছুটা অনাগ্রহ আছে। সেগুলো দূর করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। ঋণ না দেওয়ার কারণ হলো ছোট শিল্প উদ্যোক্তাকে ব্যাংক যথেষ্টভাবে চেনে না। ছোট একটি ঋণ দেওয়ার যে ব্যয় তার তুলনায় বড় ঋণ দেওয়ার ব্যয় অনেক কম। এগুলো জেনেই বড় ঋণটা আগে দিচ্ছে।’ প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বলেন, ‘এখানে বোধহয় সরকারের একটা বড় দায়িত্ব আছে।

সরকার বা এনজিও দায়িত্ব নিয়ে ব্যাংকারদের সঙ্গে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে। সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং প্রশংসনীয়। কিন্তু সেই উদ্যোগটা বাস্তবায়ন করার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা দরকার, সেখানে কিছুটা গ্যাপ রয়েছে। গ্যাপটা হলো বড় উদ্যোক্তারা ব্যাংকের কাছে পরিচিত। সেজন্য ব্যাংক একটু কার্পণ্যের সঙ্গে ছোট উদ্যোক্তাদের কাছে যাচ্ছে। এই কারণটা আরও গভীরভাবে দেখা উচিত। যাতে আরও যথেষ্ট পরিমাণ টাকা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে যায় এবং টাকা আছে।’

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘দেশের কুটির ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বিশেষ ব্যাংক অথবা ‘এসএমই বন্ড’ চালু করতে হবে। এতে কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পের সার্বিক সহায়তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি জানান, জামানত ছাড়া ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ায় ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দেশের প্রান্তিক মানুষের ব্যবসায়ী উদ্যোগ। নারী উদ্যোক্তা ঋণে ব্যাংকের বড় কর্তারা ইতিবাচক কথা বললেও বাস্তবে গ্রামীণ নারীর অভিজ্ঞতা ভালো নয়। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে ক্ষুদ্র ঋণের বিশেষ নীতিমালার তাগিদ দেন তিনি।

এ বিষয়ে সীমান্ত ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোখলেসুর রহমান বলেন, অবহেলিত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের তারা ঋণ দিতে আগ্রহী। তবে, তাদের প্রমাণ করতে হবে তারা ব্যবসা বা ক্ষুদ্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত। আর গ্রামীণ এসব উদ্যোক্তাদের ট্রেড লাইসেন্স না থাকা প্রসঙ্গে তিনি জানান, ট্রেড লাইসেন্স না থাকলেও পরবর্তীতে সে ব্যবস্থা করা হবে। অর্থনীতিতে অবদান রাখা এসব নারীদের ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হবে বলেও জানান সীমান্ত ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী।