এফ জাহান ও তৌফিক ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা:  টালমাতাল পুঁজিবাজারে অস্থির হয়ে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। তারা বর্তমান বাজারের পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছেন না। গত কয়েক কার্যদিবসের দরপতনের বিনিয়োগকারীদের মুল পুঁজি ৩০/৪০ শতাংশ হারিয়েছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা বাজারের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তেমনি বিপর্যয় সামলে পুঁজিবাজারের টানা উত্থান খানিকটা আশা জাগলেও সেই উত্থান টেকসই হয়নি। গত কয়েক সপ্তাহে বাজারের অস্বাভাবিক আচরণ ফের শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উত্থান-পতন পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক নিয়ম হলেও সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলা যাবে না। একদিন লাফিয়ে উঠলেও পরদিনই ধপাস করে পড়ে যাচ্ছে দর। এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন বড় খেলোয়াড়রা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নানা পদক্ষেপের কথা বললেও কার্যত সিন্ডিকেটের লাগাম টানতে পারেনি।

সম্প্রতি ১১টি ব্রোকারেজ হাউসকে সন্দেহজনক আচরণের দায়ে চিহ্নিত করলেও তাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। এর মধ্যে ৪টি হাউসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা শোনা গেলেও এর সত্যতা নিশ্চিত করেনি বিএসইসি। পুঁজিবাজার নিয়ে প্রভাবশালী খেলোয়াড়দের এই কারসাজিরই খেসারত দিতে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। আর কারসাজির হোতারা কামিয়ে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক বাজারের লক্ষণ নয়। পুঁজিবাজারে উত্থান-পতন থাকবে কিন্তু এভাবে হুট করে বাজারের উত্থান-পতন স্বাভাবিক নয়। কাউকে বলে বাজারে বিনিয়োগ করানো বা কারো মাধ্যমে বাজারের উত্থান তৈরি করা ভালো নয়। কারণ বাজার স্বাভাবিক গতিতে না চললে এই উত্থান বেশি দিন ধরে রাখা সম্ভব হয় না। ৬ মাস পর বাজার তার নিজস্ব অবস্থানে চলে যাবে, স্বাভাবিক গতিতে যেখানে থাকার কথা। বাজারে ম্যানুপলেশন হচ্ছে।

এদিকে টানা দরপতনের মধ্যে পড়েছে পুঁজিবাজার। গত সপ্তাহের দরপতনে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বাজার মূলধন হারিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এর মাধ্যমে টানা চার সপ্তাহের পতনে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা হারাল শেয়ারবাজার। বড় অঙ্কের বাজার মূলধন হারানোর পাশাপাশি গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে কমেছে সবকটি মূল্য সূচক। তবে লেনদেনের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক কমেছে প্রায় তিন শতাংশ। আর লেনদেন বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ।

গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। যা তার আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ৯ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। আগের সপ্তাহে বাজার মূলধন কমে ৪ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। তার আগের দুই সপ্তাহে কমে ৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা এবং ৯ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এ হিসাবে টানা তিন সপ্তাহের পতনে ডিএসই ৩১ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা বাজার মূলধন হারিয়েছে।

অবশ্য এর আগে টানা সাত সপ্তাহের উত্থানে ডিএসইর বাজার মূলধন ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা বাড়ে। বাজার মূলধন বাড়া বা কমার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ বেড়েছে বা কমেছে। সে হিসেবে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা বাড়ার পর ৩১ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা কমেছে।

এদিকে, গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১৬২ দশমিক ৬৫ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আগের সপ্তাহে সূচকটি কমে ৭৬ দশমিক ৬৯ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। তার আগের দুই সপ্তাহে কমে ১১১ দশমিক ৮২ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং ৭৩ দশমিক ১৩ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ চার সপ্তাহের টানা পতনে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক কমেছে ৪২৪ পয়েন্ট। প্রধান মূল্য সূচকরে পাশাপাশি টানা চার সপ্তাহ পতন হয়েছে ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচকের।

গত সপ্তাহজুড়ে সূচকটি কমেছে ৬৩ দশমিক শূন্য ৪ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ৯০ শতাংশ। আগের সপ্তাহে এই সূচকটি কমে ১৭ দশমিক ৪৭ পয়েন্ট বা দশমিক ৮০ শতাংশ। তার আগের দুই সপ্তাহে কমে ১৭ দশমিক ২৪ পয়েন্ট বা দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং ২৮ দশমিক ৩৩ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ২৭ শতাংশ। ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই শরিয়াহ সূচকও টানা চার সপ্তাহ পতনের মধ্যে রয়েছে। গত সপ্তাহে সূচকটি কমেছে ২৪ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আগের সপ্তাহে কমে ১৯ দশমিক শূন্য ৯ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

তার আগের দুই সপ্তাহে কমে ১৪ দশমিক ২৫ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ১০ শতাংশ এবং ২৮ দশমিক ৮৬ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ১৮ শতাংশ। সবকটি মূল্য সূচকের পতনের পাশাপাশি গত সপ্তাহে ডিএসইতে লেনদেন অংশ নেয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে মাত্র ২৪টি প্রতিষ্ঠান। বিপরীতে দাম কমেছে ২৫২টির। আর ৯১টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে ডিএসইতে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৮১৭ কোটি ২২ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয় ৭৫০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কার্যদিবসে গড় লেনদেন বেড়েছে ৬৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বা ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আর গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ৪ হাজার ৮৬ কোটি ১২ লাখ টাকা।

আগের সপ্তাহে লেনদেন হয় ৩ হাজার ৭৫২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। সে হিসেবে মোট লেনদেন বেড়েছে ৩৩৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা বা ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ। গত সপ্তাহে ডিএসইর মোট লেনদেনে ‘এ’ গ্রুপ বা ভালো কোম্পানির অবদান ছিল ৬৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এছাড়া ‘বি’ গ্রুপের ২১ দশমিক ৩৮ শতাংশ, ‘জেড’ গ্রুপের দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং ‘এন’ গ্রুপের ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ অবদান ছিল।