শফিকুল ইসলাম: দুনিয়া জুড়েই শেয়ার মার্কেট মানেই প্রতিনিয়ত উত্থান আর পতন এর খেলা। মার্কেট এই ভাল তো একটু পরেই খারাপ। সে অবস্থা বোধ করি বাংলাদেশের মার্কেটের জন্য আরো বেশী সত্য। অতি সাম্প্রতিক সময়ের সূচকমান এর দিকে নজর দিলেই তা স্পষ্ট। বিগত ২১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫১১৫। তারপর মোটামুটি ৩ সপ্তাহ পর তা বৃদ্ধি পেয়ে বিগত ১৪ জানুয়ারী ২০২১ এ পৌছালো ৫৯০৯ এ, অর্থাৎ ১৫.৫২% উত্থান। তারপর হঠাৎ করেই ছন্দপতন।

বিগত ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১ তারিখে সূচক নেমে দাঁড়ালো ৫৩৭৬, অর্থাৎ ৮.০৮% পতন। তবে কিছু কিছু শেয়ারের দাম পতন অনেক বেশী ছিল, বিশেষ করে অতি সম্প্রতি বাজারে আসা কিছু কোম্পানীর শেয়ারের দাম প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে বিগত ২-৩ মাসের মধ্যে বাজারে আসা অন্তত ৫টি কোম্পানীর (এনার্জিপ্যাক, ক্রিষ্টাল ইন্সু, রবি, ডমিনেজ স্টীল, এবং এওএল) দাম ওপেনিং প্রাইস থেকে ক্রমাগতভাবে শুধু বাড়ছিল।

তারপর যখন মার্কেটে পতন ঘটলো তখন সেসব শেয়ারে ৩০% থেকে ৫০% পর্যন্ত নেই। অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে যারা লোভের বশবর্তী হয়ে অতি উচ্চ দামে সেসব শেয়ার কিনেছিল তাদের পুঁজির কি অবস্থা। তাইতো সবসময় বলা হয় যে শেয়ার মার্কেটে টিকতে হলে মার্কেট সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা এবং সেইসাথে সঠিক কৌশল ও পদ্ধতি আগে জানতে হবে। আমি এ নিবন্ধে আমার নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে সাধারন বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু টিপস উল্লেখ করতে চাই- যা মেনে চললে উত্থান-পতনের নিত্য খেলায় তাদের টিকে থাকা সহজতর হতে পারে।

(১) সেক্টরভিত্তিক দামের উঠানামাকে কাজে লাগান। গভীরভাবে বাজার পর্যালোচনা করলে সহজেই বুঝা যায় যে কোন বিশেষ দিনে কিংবা একই দিনের বিভিন্ন সময় এক বা একাধিক সেক্টর আপ এবং অন্যসব সেক্টর ডাউন থাকে। প্রায়শঃই দেখা যায় যে কিছু সেক্টরের প্রাইস ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। আবার দুই একদিন পরেই সেই সেক্টরের শেয়ার প্রাইস নেমে যাচ্ছে।

তাই বিনিয়োগকারীর পোর্টফলিওতে যদি একাধিক সেক্টরের ডাইভারসিফাইড শেয়ার থাকে তবে যে সেক্টরের দাম বাড়লো তা বিক্রি করে পতন হওয়া সেক্টরের উপযুক্ত কোন কোম্পানীর শেয়ার ক্রয় করা যেতে পারে। তারপর কয়েকদিন পরে আজকের পতনমূখী শেয়ারটির সেক্টর যখন আপ হবে তখন ঐ শেয়ারটির দামও সম্ভবত বাড়বে এবং তখন তা বিক্রি করে লাভবান হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

বিনিয়োগকারী যদি অতিমাত্রায় লোভী না হয়ে থাকেন তবে সে কৌশল কাজে লাগতে পারে। তবে যদি দেখা যায় যে কোন শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার পর তা আর কমছেই না, বরং বেড়েই যাচ্ছে তবে তা নিয়ে আফসোস করা যাবে না; বরং নির্ধারিত হারের সীমিত লাভ পাওয়ামাত্রই এক্সিট নেওয়ার পলিসিতে দৃঢ় থাকতে হবে।

(২) মৌল্ভিত্তির শেয়ারে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখুন। সাধারনভাবে দেখা যায় যে মৌল্ভিত্তির ভাল কোম্পানীর শেয়ারদামে আনুপাতিকভাবে কম উত্থান-পতন ঘটে। টাকার অংকে সেরুপ উঠানামা অনেক্ক্ষেত্রে বেশী মনে হলেও শতকরা হিসাবে তা সাধারনত কম হয়ে থাকে। সাধারনত ভাল কোম্পানীর উদ্যোক্তারা শেয়ার ম্যানিপুলেশনের সাথে জড়িত থাকেন না এবং তাদের রিপোর্টেড কোয়ার্টারলি ইপিএস এর হিসাবও বছরশেষে পরিবর্তিত হয় না। তাই সেসব শেয়ার নিয়ে বাজারে গুজব সৃষ্টির সুযোগ কম থাকে, যার ফলে দামের উত্থান-পতনও কম হয়।

তবে ভাল কোম্পানীর দাম স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশী হয় যে কারণে প্রাপ্ত ডিভিডেন্ড ইল্ড কম হতে পারে। তবুও সেসব কোম্পানীতে বিনিয়োগের বড় সুবিধাই হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদে পুঁজি হারানোর আশংকা কম থাকে। তদুপরি, কোন কারণে মার্কেট ডাউন থাকলেও অন্তত ডিভিডেন্ড ভোগ করে ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেয়া যায়। তাই আমার পরামর্শ থাকবে যে ক্ষুদ্র পুঁজির সাধারন বিনিয়োগকারীগণ মৌল্ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানীর শেয়ারে বিনিয়োগ সীমাবদ্ধ রাখবেন।

(৩) সেকেন্ডারী মার্কেট থেকে আইপিও’র মাসখানেকের মধ্যে শেয়ার ক্রয় করবেন না। শেয়ার মার্কেট প্রচন্ড আবেগ ও গুজবের জায়গা। যখনই কোন কোম্পানী প্রথম তালিকাভূক্ত হয় তখন তার সম্পর্কে আবেগ ও গুজব উভয়ই থাকে তুংগে। সে কারণেই দেখা যায় যে অতিরিক্ত প্রত্যাশার ফলে দাম অত্যধিক বেড়ে যায়। প্রায়শঃই সে আবেগ কয়েকদিনের মধ্যে থিতিয়ে পড়ে এবং তখন উচ্চদাম ধরে রাখা সম্ভব হয় না।

তাই সাধারন বিনিয়োগকারীদের উচিত হবে আইপিও’র শেয়ার বাজারে ট্রেড শুরু হওয়ার পরপরই তা না কেনা। যদি কিনতে হয় তবে বেশ কিছুদিন পর তার প্রাইস স্ট্যাবল হলে কেনা যেতে পারে। তবে যারা অধিকতর অভিজ্ঞ ও প্রচুর ক্যাশ নিয়ে মার্কেটে খেলছে তাদের কথা আলাদা। তারা যেমন বড় অংকের লাভ করে তেমনি অনেক সময় প্রচুর লসেরও সন্মুখীন হয়ে থাকে, যা সাধারন বিনিয়োগকারীদের জন্য কোন যৌক্তিক কৌশল হতে পারে না।

(৪) কোম্পানীর প্রডাক্টস বা সেবার চাহিদা সম্পর্কে খোঁজখবর নিন। কোম্পানী যেসব সেবা বিক্রয় করে কিংবা প্রডাক্টস উৎপাদন বা বাজারজারজাত করে তার চাহিদা কেমন, ঐসব পডাক্টস ও সেবার ক্ষেত্রে তাদের মার্কেট শেয়ার কেমন, কারা তাদের প্রতিযোগী, প্রতিযোগী কোম্পানীর তুলনায় আলোচ্য কোম্পানীর সুবিধা অসুবিধা কি তা বুঝতে চেষ্টা করার গুরুত্ব অপরিসীম।

অনেকক্ষেত্রে কোন কোম্পানীর মার্কেট শেয়ার কেমন তার ধারনা পেতে পাড়া মহল্লার দোকানে খোঁজ নিলেই পাওয়া যায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। যেমন, কোন ফার্মা কোম্পানীর তৈরী ঔষধ কেমন চলে তা জানতে স্থানীয় কয়েকটি ফার্মেসীকে জিজ্ঞাসা করাই যথেষ্ট। কোম্পানীর প্রডাক্টসের চাহিদা মূল বাজারে ভাল থাকার অর্থই হচ্ছে তারা সক্রিয় এবং বার্ষিক টার্ণওভার ভাল যা বছরশেষে ইপিএস বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে বলেই প্রত্যাশা করা যায়।

(৫) সাপোর্ট-রেজিষ্ট্যান্স জোন বুঝে ট্রেড করুন। এটি একটি টেকনিক্যাল টার্ম। তবে বিশ্বজুড়ে এর ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সাপোর্ট হলো প্রাইস চার্টের নীচের সেই অংশ যেখান থেকে সাধারনভাবে নামে না এবং যেখান থেকে মার্কেট ঘুরে দাড়ানোর সম্ভাবনা বেশী থাকে। রেজিষ্ট্যান্স হচ্ছে চার্টের উপরের রেঞ্জ যেখান থেকে ব্রেক আউট না ঘটলে প্রাইস আর বাড়ে না। তাই সাপোর্ট রেঞ্জে শেয়ার ক্রয় আর রেজিষ্টান্সে বিক্রয় নিশ্চয়ই লাভজনক। নিজ প্রচেষ্টায় সাধারন বিনিয়োগকারীগণ সে সম্পর্কে বেসিক হলেও ধারনা নিয়ে উপকৃত হতে পারেন।

(৬) অত্যধিক আবেগপ্রবণ হয়ে ট্রেড করবেন না। শেয়ার মার্কেটে বিফল হবার প্রধানতম কারণ হলো নিজের আবেগজনিত (Emotions) সমস্যা। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম না হলে এ মার্কেটে কখনো সফল হওয়া যায় না। শেয়ার কেনা বা বেচার সময় আবেগ কাজ করলে ভূল হবে বেশী। বেশীরভাগ মানুষের বিশেষ কোন কোম্পানীর প্রতি বিশেষ পছন্দ বা অপছন্দ থাকে।

হয়তো পূর্বে সেই কোম্পানীর কোন ডিল থেকে লাভ বা লোকসানের কারণে সেরুপ পছন্দ বা অপছন্দ তৈরী হতে পারে। কিন্ত সেটা হলে চলবে না, সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে ট্রেড করতে হবে। কোন বিশেষ শেয়ারকে ভালবেসে তার সম্বন্ধে অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করার কারণে দেখা যায় যে দাম অনেক বাড়ার পরও বিনিয়োগকারী ভাবে্ন যে শেয়ারটির দাম আরো বাড়বে এবং তিনি তা বিক্রি করা থেকে বিরত থাকেন। পরে দেখা যায় মার্কেট পড়ে গেলে সে শেয়ারটির দামও পড়ে গেছে।

শফিকুল ইসলাম

অতিরিক্ত সচিব (অবঃ)
Email: msislam201386@gmail.com